Love Death + Robots সিজন ৩ নিয়ে তাৎক্ষনিক রিভিউ



Love Death + Robots জমিয়ে জমিয়ে দেখবো চিন্তা করেও পারলাম না। নয়টা এপিসোড দেখে শেষ করে ফেললাম সারাদিনে। এর আগের সিজন থেকে এবারেরটা নি:সন্দেহে ভাল হয়েছে।

রেটিং করে ফেলি পর্বগুলোর:
বেস্ট: Bad Travelling, Swarm, In Vaulted Halls Entombed, Jibaro
এ চারটা এপিসোডের মধ্যে কোনটাকে আগে রাখবো সেটা বাছাই করা ডিফিকাল্ট-চারটাতেই হরর এলিমেন্ট দারুণ ভাবে আছে। Jibaro ‘র মেকিং অনবদ্য, সবচেয়ে আলোচিত হবে সেটা আন্দাজ করা যায় । In Vaulted Halls Entombed লাভক্রাফটিয়ান বা কসমিক হরর বলা যায়-এটা যথেষ্ট ক্রিপি। Bad Travelling এর গল্প খুবই ভাল এবং এটাকেও লাভক্রাফটিয়ান জনরায় রাখা যায়, Swarm এ বেশ পুরান একটা কনসেপ্টকে নতুনভাবে দেখানো হইছে।
গুড: The Very Pulse of the machine, Kill team Kill, Mason's Rat
The Very Pulse of the machine ভিজুয়্যালি অসাধারণ-কনসেপ্টটাও বেশ নতুন। Kill team Kill নাইনটিজের অ্যানিমেশনের মত করে বানানো-গল্পও ভাল। Mason's Rat দেখে একটু চমকালাম-কনসেপ্টটা আমার ’খরগোশকে মারো’ গল্পের সাথে কিছুটা মেলে। যেহেতু দ্বিতীয়টা আগে প্রকাশিত হয়েছে তাই আমাকে দোষ দেয়ার সুযোগ নাই। 😎

ব্যাড: three Robots এবং Night of the Mini Dead
এই দুটো খুব একটা পছন্দ হয় নাই। এই সিরিজটাতে কিছু ফানি এপিসোড রাখতে গিয়ে এর ওয়েটটা কমানো হইছে, আগের সিজনেও তাই ছিল।

সত্যজিতের ছোটগল্প সত্যজিতের অনুবাদ





ছোটগল্প

বরেণ্য চলচিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায় সাহিত্যিক হিসেবে নিজেকে মেলে ধরেন বেশ দেরি করেই। আর তাঁর লেখার ভঙ্গিটা যেন তাঁর সিনেমার মত গম্ভীর মেজাজের নয়, বরঞ্চ চমক আর রোমাঞ্চে মোড়া- ঠিক মেলানো যায় না যে পথের পাঁচালী,কাঞ্চনজঙ্ঘা, চারুলতা ইত্যাদির পরিচালকই এমনধারা শেষ প্যারার টুইস্ট বা পাঞ্চ লাইন দিয়ে গল্পের ইতি টানছেন। ফেলুদা, শঙ্কু বা তারিনীখুড়োর মত জনপ্রিয় সিরিজগুলোর পাশাপাশি তার স্বতন্ত্র ছোট গল্পগুলোর জন্যও তিনি বাঙালি পাঠক হৃদয়ে জায়গা করে আছেন-আর রহস্য রোমাঞ্চ ভক্ত পাঠকরা তাকে রেখেছেন একেবারে তাদের মণি কোঠাতে। 

সত্যজিৎ পেশাদার ভিজুয়াল ডিজাইনার হিসেবে  কাজ করেছেন তার জীবনের দীর্ঘ সময়, তাই চিত্রকলায় তার আগ্রহ,শ্রম এবং অবদান সবই বেশ গভীর। তারই ছায়া পড়েছে তার একদম প্রথম দিকে লেখা ছোট গল্পে। চল্লিশ এর দশকের শুরুতে তার ইংরেজিতে লেখা দুটি ছোট গল্প Abstraction এবং Shades of grey দুটিই পেইন্টিং নিয়ে। তবে ওই যে শেষ প্যারা চমক তা এ দুটি গল্পেও বর্তমান ছিল। এরপর বহুদিন তিনি স্বতন্ত্র ছোটগল্প লিখেননি। বিশ বছর পরে ১৯৬২ তে লিখলেন প্রথম বাঙলা গল্প ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’ এক ভিনগ্রহবাসী নিয়ে, যে গল্পটাই হয়তো তার ‘দি এলিয়েন’ নামক চিত্রনাট্য লেখার প্রেরণা, যেটা নিয়ে সত্যজিৎ হলিউডেও গিয়েছিলেন, কলাম্বিয়া পিকচার্স এর সে সিনেমা বানানোরও পরিকল্পনা ছিল- নানা কারনে সেটা অবশ্য পরে হয়নি, তবে সত্যজিৎ সেসময়কার ভিনগ্রহবাসীর যে অমায়িক চিত্র এঁকেছেন সেটা বেশ অনন্য ছিল। 

তার ছোটগল্পগুলো প্রায় সবই কিশোর উপযোগী, এর একটা কারন হতে পারে তিনি মূলত শিশু-কিশোর পত্রিকা ‘সন্দেশ’ এর জন্যই এগুলো লিখতে শুরু করেন। বিষয় বৈচিত্রে গল্পগুলো রহস্য, রোমাঞ্চ, কল্পবিজ্ঞান, ভৌতিক ইত্যাদি নানা ধরনের, সাধারণ বৈশিষ্ট ছিল- কাহিনীর টুইস্ট কিংবা থ্রিল, সাদামাটা ভাষা, অ্যাডভেঞ্চার-মুখীতা, মনে রাখার মত এন্ডিং ইত্যাদি। সন্দেশ পত্রিকা ছাড়াও তার গল্পগুলো বারটি বারটি করে সংকলন করে বই হিসেবে বেড়িয়েছে নানা সময়ে।  সংকলনের নামই থাকতো সংকলনে যে একডজনই গল্প আছে তা নিশ্চিত করে- ‘এক ডজন গপপো, আরো একডজন, আরো বারো, একের পিঠের দুই, এবারো বার, জবর বারো, বা! ১২’ ইত্যাদি। 

সত্যজিতের ছোটগল্প বাঙালি পাঠকদের জন্য বিস্ময়-রসের খোরাক হয়ে থাকবে সবসময়-সে কথা হলফ করে বলা যায়, আটপৌরে জীবনের নানা ব্যস্ততায় অতিষ্ঠ পাঠক সহজেই পালাবার পথটি তার ডজন ডজন গল্পে সহজেই খুঁজে পাবেন। উৎকন্ঠা, চমক আর মন-ধাঁধানো প্লটের সাথে সরল-মনোমুগ্ধকর ভাষাশৈলীতে মোড়া তার এসব ছোটগল্প তাই অতিক্রম করেছে বয়সের রেখা, ছেলে-বুড়ো সবার জন্যই সত্যজিৎ তার মনিমুক্তো ছড়িয়ে রেখে গেছেন। 



অনুবাদ

সত্যজিৎ লেখালেখির ক্ষেত্রে আর্থার কোনান ডয়েল দ্বারা বেশ প্রভাবিত ছিলেন সেটা হয়তো অনুমান করা চলে, কেননা শার্লক হোমস আর ফেলুদা, বিজ্ঞানী চ্যালেঞ্জার আর প্রফেসর শঙ্কু, এমনকি বেশ কিছু ছোট গল্পও তাদের দু’জনার একই বৈশিষ্টময়। কোনান ডয়েল যে আসলেই সত্যজিতের প্রিয় একজন লেখক ছিলেন সেটার প্রমাণ মেলে তার করা অনুবাদ গল্প গুলোর দিকে তাকালে। ডয়েলের দ্য টেরর অব ব্লু জন গ্যাপ, দ্য ব্রাজিলিয়ান ক্যাট এর অসাধারণ অনুবাদ করেছেন তিনি  যথাক্রমে ব্লু জন গহ্বরের বিভীষিকা এবং ব্রেজিলের কালো বাঘ শিরোনামে। এছাড়া সন্দেশের জন্য তিনি অনুবাদ করেন রে ব্রাডবেরির ‘মারস ইজ হেভেন’ ( মঙ্গলই স্বর্গ), আর্থার সি ক্লার্ক এর ‘দি নাইন বিলিয়ন নেমস অব গড’ (ঈশ্বরের ন’ লক্ষ কোটি নাম)। এছাড়া মোল্লা নাসিরুদ্দিনের অনেকগুলো কৌতুক তিনি সন্দেশের জন্য চমৎকার রসালো আর মেদহীন অনুবাদ করেন। 

তবে যে অনুবাদ কর্মটির জন্য তাকে অনুবাদে অদ্বিতীয় ধরতেই হবে সেটি হল ‘তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম’। বাংলায় অর্থ-অপ্রধান সাহিত্য বা ননসেন্স ধারাকে জনপ্রিয় করেছেন সুকুমার রায়। আর তারই সুযোগ্য পুত্র সত্যজিৎ পশ্চিমের অসাধারণ কিছু ননসেন্সকে অনুবাদের মত বড় একটি কাজ করে গেছেন। সত্যজিৎ তার পিতার কিছু ছড়াকে যেমন ইংরেজিতে রূপান্তর করেছেন নানা সময়ে, তেমনি ননসেন্স সাহিত্যের দিকপাল এডওয়ার্ড লিয়ার বা লুইস ক্যারলের বেশ কিছু কাজ বাংলায় পাল্টেছেন এই বইটিতে- পাল্টেছেন বলাই ভাল, কারন এসবের অনুবাদ ঠিক হয় না, মূলভাবটা নিয়ে তিনি নিজের মত করে লিখেছেন- সেটা বইয়ের শুরুতে তিনিও কবুল করেছেন। এডওয়ার্ড লিয়র তার জীবদ্দশায় লিখেছেন অসংখ্য লিমেরিক, মানে পাঁচ বাক্যের ছড়া- সাথে এঁকেছেন ছবি। সত্যজিৎ সেই ছবিগুলো রেখে আনকোরা বাংলায় রূপান্তর করেছেন সেসব অনেকগুলিই। লিয়রের Jumblies অবলম্বনে পাপাঙুল, কিংবা ডং উইথ লুমিনাস নোজ এর যে বিস্ময়কর অনুবাদ তিনি করেছেন সেগুলো মৌলিক বলাই যৌক্তিক। লুইস ক্যারলের বিখ্যাত জবরওয়াকি সহ বেশ কয়েকটা ছড়ার অনুবাদও একই ভাবে করেছেন। এসব পড়লে মনে হয়- সত্যজিৎ চাইলেই তার পিতার মত ছড়ার জগতকেও মাতিয়ে রাখতে পারতেন। সুকুমারের আবোল তাবোলের যে বিদায়ী করুণ বাক্যদ্বয়- 

‘ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর

গানের পালা সাঙ্গমোর’

ঠিক তার আগের লাইনই ছিল 

‘আদিম কালের চাদিম হিম,

তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম’ 

সেই আবোল তাবোলের ধারাবাহিকতাই ধরে রাখার জন্যই হয়তো সত্যজিৎ বইয়ের নামটাও সেখান থেকেই নিয়েছেন। 


বই: যদি একে রূপকথা বলি। অহনা বিশ্বাস


কবি ও লেখক অহনা বিশ্বাস বীরভূমের একটি আদিবাসী গ্রামে দীর্ঘদিন থেকেছেন, খুব কাছ থেকে তাদের একজন হয়ে দেখেছেন সাঁওতাল জীবন। সে অভিজ্ঞতারই নির্যাস যেন বইটি। বইটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ( একটা চ্যাপ্টার বাদে) একজন এক আদিবাসী নারীর বর্ণনায় নিজস্ব ভঙ্গিতে বলে যাওয়া। ঠিক যেন অহনা বিশ্বাস-কে শুনাচ্ছেন নিজ স্বপ্ন আর সংগ্রামের কথা, প্রেমের কথা, দিকুদের থেকে তাদের জীবন কতটা ভিন্ন সেসব কথা।
দিদি সম্বোধন করে অধ্যায়ের পর অধ্যায় সে বর্ণনা করে যায় তাদের জীবন, যে জীবন যতটা স্বাধীন আবার ততটাই শেকলে মোড়া, হান্ডি খেয়ে ওরা রাতের পর রাত মাতাল হয়ে পড়ে থাকে, টামাক বাজায় মনের আনন্দে, নদীর ধারে ঝিনুক কুড়াতে যায়, রকুইচন্দন গাছের শাখায় চাঁদ উঠলে গলা ছেড়ে গান গায়। পুরো পৃথিবীর সব আদিবাসীর মতই দিকুদের সাথে ওদের বিবাদ, দিকুরা ওদের ফরেস্ট গার্ড দিয়ে জমিজমা কেড়ে নেয়, ওদের এলাকায় হোটেল তোলে, সেখানে কাজের লোভ দেখিয়ে ওদের বেঁচে দেয়, পয়সা গছিয়ে জমিজমা কেড়ে নেয়। পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় নতুন নতুন গল্প, কোনটা দেবতা বোঙাকে দর্শনের ঘটনা, কোনটায় পাশের পাড়ার চাপলু বুড়োর কীর্তি, কখনো প্রেম-বিয়ে, এসব নিয়ে ওদের নিজস্ব ধ্যান-ধারনা যেটায় শ্রোতা অবাক হতে পারে ভেবে নিজ থেকেই বলা,‌' আমাদের অমন হয় দিদি!' তাদের সরল জীবনে কেউ কাউকে অবিশ্বাস করলে বোঙাথানে গিয়ে দেবতার নামে শপথ করে কথাটা বললেই সবাই মেনে নেয়, দশজনকে পেটপুড়ে হান্ডি খাওয়ালেই সবাই খুশি!
বিবেকানন্দ সাঁতরার ইলাস্ট্রেশনে কলকাতার গাংচিল থেকে প্রকাশিত বইটা আমাদের দেশে পাওয়া যাবে অঙ্কুর প্রকাশনীতে।

ডাক্তারের হাতের লেখা নিয়া হাইকোর্ট দেখা



১.
এককালে আমাদের যাদের হাতের লেখা খারাপ তাদের বাপ-মারা এই ভেবে সান্ত্বনা পাইতো যে ছেলে অন্তত ডাক্তার হতে পারবে। আক্ষরিক অর্থেই আমার অনেক সহপাঠী, সহকর্মী হাতের লেখা খুবই বাজে-ওরা আমাকে বলেছে ওদের ওই দুর্বোধ্য হাতের লেখাই এ পর্যন্ত আসতে ওদের উৎসাহ দিয়েছে। মেডিকেলে রিটেন পরীক্ষার তেমন মূল্য নাই। কারন আমরা যদি কোন প্রশ্নের উত্তর না পারতাম- সেটা হায়ারোগ্লিফিক লিপিতে লিখে দিয়ে আসতাম, স্যাররা মার্ক দিতে বাধ্য- ছেলে ডাক্তার হবে, হাতের লেখা বোঝা যাবে না এটাই সত্য, কি লিখছে সেটা সত্য না। এ কারনেই মেডিকেলের বড় বড় পরীক্ষাগুলো হয় গোল্লাপূরণ করে। গোল্লাপূরণ কখনো দুর্বোধ্য ভাবে করা যায় না।
২.
ডাক্তারদের হাতের লেখা খারাপ এটা শুধু আমাদের দেশের জন্য সত্য না। দুনিয়ার সব দেশে তাদের লেখা নিয়ে এই কথা প্রচলিত। তবে হাইকোর্ট যখন রায় দিল হাতের লেখা বোধগম্য করতে হবে তখন কিছু প্রশ্ন সামনে আসে। হাতের লেখা বোধগম্য বলতে আসলে কি বোঝায়- আমি যে কারো হাতের লেখা নিয়েই বলতে পারি- এই লেখা বোধগম্য না। কারন লেখা খুব স্বতন্ত্র জিনিস, একজনের সাথে অন্য জনের হাতের লেখা খুব কম মেলে। তাই এই বোধগম্যতার স্টান্ডার্ড আসলে কিভাবে যাচাই করা হবে?
যেকোন দুর্বোধ্য হাতের লেখার ডাক্তার অন্তত একশ জন ঔষধ বিক্রেতার সাক্ষ্য নিতে পারবে এই মর্মে যে তারা তাঁর লেখা বুঝেছে। তাই এই অভিযোগ আসলে কিভাবে করা হবে আমার কাছে পরিস্কার না।
৩.
এই আইনটা সত্যিই যদি কার্যকর করা হয়- সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে কিন্তু ডাক্তাররাই। কি রকম- সরকারি হাসপাতালের আউটডোরের চর্ম ও যৌন বিভাগের সামনে একদিন চলে যান। দেখবেন লাইনে দাড়ায় আছে মিনিমাম দুইশো রোগী ( স্বাভাবিক, এদেশের মানুষের চুলকানি বেশি)।
এখন সেখানে বসা ডাক্তার সাহেব স্বভাবতই ত্রিশ চল্লিশ সেকেন্ডে রোগ নির্ণয় করে প্রেসক্রিপশন লেখে। তার হাতের লেখা জয়নুল আবেদীনের মত হলেও এক সপ্তাহের ভেতরে সেগুলো বিগড়ে যাবে- হয়ে উঠবে পালি বা হিব্রু ফন্ট- বুঝতে পারবে কেবল ঔষধের দোকানদার। এখন এই ডিউটি ডাক্তার যদি আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সুন্দর হরফে লিখতে যায়- সবদিক থেকেই তার লাভ। বিশ পঁচিশটা রোগী দেখলেই হবে- মাথা থাকবে পরিস্কার- রাতে ঘুমও ভাল হবে।
৪.
অল্প স্বল্প অভিযোগে আমরা সরব থাকি, অধিক অভিযোগে নির্বাক।
কথাটার উপযুক্ত প্রয়োগ টের পেয়েছি যখন ইন্টার্নি কর্তাম তখন দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়া কত কিছু লিখতাম, এখন উপজেলা পর্যায়ে ডিউটি করে আমি পাথর হয়ে গেছি। মনে হয় ধুর বা... , কি হবে এইসব দশজনকে বলে।
আমাদের হাইকোর্ট 'সুন্দর হস্তলিপি' নিয়া চিন্তিত, কিন্তু পৃথিবীর আর কোন দেশে যে কেউ চাইলেই যে কোন ঔষধ ফার্মেসী থেকে কিনতে পারে কিনা সেটা আমার জানা নাই- ভীষণ সব দুর্নীতিগ্রস্থ দেশেও এটা স্বপ্নাতীত ব্যাপার, আর আমাদের শুধু গ্রামে গঞ্জে না, রাজধানী শহরও যেন সোনার খনি- চাইলেই যেকোন ঔষধ কেনা যায়। উন্নত দেশের অনেকে নিশ্চয়ই এটা জানলে আমাদের হিংসা করতো। হাইকোর্ট বা কেউই এই ঔষধের মহোৎসব নিয়া ভাবিত না।
৫.
আর ভাবছেন প্রেসক্রিপশন ছাড়া ঔষধ কেনা বন্ধ করবেন? এই প্রেসক্রিপশন যোগাড় করাও কোন ব্যাপার না। এদেশে বৈধ ভাবেই যে কেউ নামের আগে ডাক্তার লাগাতে পারে, রিপিট করছি বৈধ ভাবে। হাসপাতালে ডাক্তারদের সহকারী হিসেবে যাদের কাজ করার কথা, হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্ট বা স্যাকমো যারা- তারা কিন্তু একটা মামলা দিয়ে রাখছে তারা কেন নামের আগে ডাক্তার লাগাতে পারবে না- সেটার কিন্তু রায় হয় নাই। হাইকোর্ট এখানে নিরব। আর নীরবতা সম্মতি- আইনতই। তাই তারা নিজেদের নামের আগে ডাক্তার লিখছে- এইটা পুরোপুরি বৈধ। তারা যেকোন ঔষধ প্রেসক্রাইব করতে পারবে- আমি আপনি টু শব্দটি করতে পারবো না। গ্রামে গঞ্জে তারাই রোজ হাজার হাজার প্রেসক্রিপশন লিখছে, মজার ব্যাপার হচ্ছে আমি যেখানে আছি সেখানে তাদের অনেকের ভিজিট বিসিএস ক্যাডার হয়ে আসা ডাক্তারদের চেয়ে বেশি বা সমান!!
অথচ দুনিয়ার সব দেশেই প্রেসক্রিপশন লেখার জন্য লাইসেন্স লাগে, উন্নত দেশে ডাক্তারি পড়া শেষ করেও সেই লাইসেন্সের জন্য আলাদা পরীক্ষা দেয়া লাগে। আমি আমার দেশের যত বড় ডিগ্রী নিয়াই ইয়োরোপ আম্রিকায় যাই না কেন- ওদের দেশের নিজস্ব পরীক্ষা দিয়ে তারপর প্রেসক্রিপশন লেখার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। আর আমাদের দেশ ওপেন ফিল্ড, ভারত থেকে যদু-মধু ডাক্তাররা এসে অ্যাপোলোর চেম্বারে বসে রোগী দেখে যায়- কেউ টেরই পায় না।
৬.
এদেশ আসলে স্বর্গরাজ্য, হলিউডি মুভি টিভি সিরিয়ালে দেখি- ডাক্তার হয়েও কোন কোন ঔষধের জন্য ওরা কেমন কান্নাকাটি করে- সহকর্মীর হাতে পায়ে ধরে কয়- আমারে ওই ঔষধটা লেইখা দেও না, আমি ব্যথা সহ্য করতে পারতেছি না। সহকর্মী ডাক্তার কয়, তুমি আমার লাইসেন্স বাতিলের ধান্দা করতেছো। আর আপনি আমি দেখেন কি সুখে আছি- দুনিয়ার যেকোন অ্যান্টিবায়োটিক, যেকোন ব্যাথার ঔষধ, ঘুমের ঔষধ আমরা চাইলেই কিনে খাইতে পারি, পাড়া প্রতিবেশী ও আত্মীয় স্বজনকে খাওয়াতে পারি। এই একান্ত সুখে আমাদের মাঝে হাইকোর্ট কখনো বাঁধা হয়ে দাড়ায় নাই।
তাই বিভেদ ভুলে হাইকোর্টের পাশে থাকুন। সুখে থাকুন।

বাচ্চাদের হুমায়ূন আহমেদ



আমাদের দেশে বাচ্চাদের জন্য, মানে সদ্য স্কুলে যেতে শুরু করা থেকে ক্লাস ফাইভ-সিক্স পর্যন্ত পড়ুয়া বাচ্চাদের জন্য ভাল লেখার যে খুব আকাল, এটা সবাই মানে। আর আমাদের বড়বড় লেখকরাও ভারী ভারী লেখা লিখতে লিখতে ভুলে যান সদ্য দাঁত পড়া,স্কুলের ব্যাগ কাঁধে বওয়া বিরাট এক পাঠক শ্রেণী বসে আছে একটা গল্প শোনার জন্য- ক’দিন আর মায়ের মুখের রাজকন্যা-রাজপুত্রের গল্প ভাল লাগে! বাবাদের তো কথাই নেই, গল্প বলতে গিয়ে মাঝপথে ভুলে বসে থাকে এতক্ষণ কী কী বানিয়ে বানিয়ে বলেছেন। তাই হোমওয়ার্ক শেষ করে ওরা বসে বসে ডোরেমন দেখে, বিদেশী ওয়াল্ট ডিজনীর লিটল মারমেইডে মজে থাকে।
এই দশ-বারো বছরের নীচের বাচ্চাদের জন্য লেখাটা বেশ কঠিন, তাই এদের জন্য ভালো লেখা লিখতে পারা লেখক বিরল । আমার মতে এই পাঠক শ্রেণীর জন্য গল্প-ছড়া লিখিয়ে নেয়া উচিত দেশের সবচেয়ে সেরা লেখকদের দিয়ে, কারণ শিশুসাহিত্যের মত সার্বজনীন সাহিত্য কর্ম ক’টাই বা আছে! ভাল মানের শিশুতোষ গল্প পড়ে আনন্দ পায় সব বয়েসীরা ।
বাচ্চাদের জন্য এইরকম গল্প উপন্যাস হুমায়ূন আহমেদ কেমন লিখেছেন? জবাবটা হল- খুব বেশি না, সাকুল্যে তিনশ- সাড়ে তিনশ পৃষ্ঠার এক বইয়ে হয়তো তার বাচ্চাদের জন্য লেখা সব গল্প এঁটে যাবে। ব্যাপারটা ভাবলেই বেশ খারাপ লাগে। মনে হয়- আহা, যদি আরো অনেক গল্প উপন্যাস লিখে যেতেন তিনি, কী ভালোই না হত! কত কত ছেলেমেয়ের শৈশব দারুন সব জাদুকরী গল্পে ভরে থাকতো। গল্পগুলো পড়লে সে আফসোস আরও বেড়ে যায়।
তিনি লিখেছেন একদমই অন্যরকমের রূপকথা, ‘তোমাদের জন্য রূপকথা’। যে সব রূপকথায় কোন রাক্ষস-খোক্ষস নেই, রাজপুত্রের তলোয়ারবাজী নেই, সাপের মাথায় মণি নেই, রাজা-রাজড়াদের গল্পও তেমন নেই। আছে একদম সাধারণ মানুষদের নিয়ে গল্প। একটা ছোট্ট মেয়ে ঘুম ভেঙে দেখে তার ঘরে এক পরী-সেটা নিয়ে গল্প, এক জনের আদরের নীল হাতী একদিন আর একটি বাচ্চা বায়না ধরে নিয়ে যায়-সে গল্প।
হুমায়ূন আহমেদের শিশুতোষ গল্পের একটা বেশ বড় বৈশিষ্ট্য হল এখানে সদ্য পড়ুয়াদের ভয় পাওয়ার মত বিষয়গুলোকে একদমই নিরীহ আর আপন করে উপস্থাপন করা হয়। তাই পাঠকরা ভয় পাওয়ার বদলে ভালবাসতে শুরু করে কানী ডাইনীকে। সে যখন বাচ্চাদের ধমক দেয়- মন্ত্র দিয়ে পাথর বানিয়ে ফেলবে, তাতে কেউ ভয়তো পায়ই না বরঞ্চ হাসি ফোটে মুখে।
তার গল্পের ভূতগুলো নিজেরাই ভীতু, নয়তো লাজুক। ‘মিরখাইয়ের অটোগ্রাফ’ গল্পে যেমন দেখা যায় এক ভূত ভয় দেখানোর পরীক্ষায় পাশ করতে পারে না বলে নীতুর বড় মামা’র কাছে এসে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। তখন তিনি ইচ্ছা করেই ভয় পাওয়ার অভিনয় করেন। আরেক গল্প ‘বোকাভূ’ তেও এমন এক ভূত থাকে যার মানুষকে ভয় দেখাতে ভাল লাগে না, সেটা নিয়ে তার ভূত বাবার দুঃশ্চিন্তার সীমা থাকে না।এসব ভূতকে ভাল না লেগে পারা যায় না। দৈত্য নিয়েও এমন এক গল্প আছে- ‘বোকা দৈত্য’ । সেখানে দৈত্যকে ভয় পাওয়ার বদলে নিদারুণ এক মায়া তৈরি হয় সেটার জন্য।
হুমায়ূন আহমেদের যাবতীয় লেখারই একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ঘটনার গতি প্রকৃতি স্বাভাবিক নয়, স্বভাবতই যা করার কথা তা কেউ করছে না, স্বভাবতই যা হওয়া উচিত সেটা হয়তো হচ্ছে না। এটা যদিও অধিকাংশ গল্পকারের গল্পেই থাকে, কারন যা স্বভাবতই ঘটে থাকে তা বলবার জন্য কেউ আসর জমিয়ে বসে না, তারপরও অনেক উপন্যাসিকের তুলনায় হুমায়ূন আহমেদের লেখায় ব্যাপারটা অনেক বেশি। এই ফ্যানসিফুল টুইস্ট তার শিশুতোষ গল্পগুলোতেও ছিল। তাই দেখা যায় তার গল্পে আলাদীনের চেরাগ পেয়ে দরিদ্র স্কুল শিক্ষক অভাবেই দিন কাটান- পরশ পাথর পেয়েও তিনি মুখ ফিরিয়ে নেন। আরেক গল্পে বাবলুও তার প্রদীপের দৈত্যের কাছ থেকে কিছুই আদায় করে নেয় না।
হুমায়ূন আহমেদের গল্প-উপন্যাসের শেষ করা নিয়ে পাঠকের ভিতরে একধরণের অতৃপ্তি থাকে, কারন অনেককেই আমি বলতে শুনেছি- তাঁর গল্পটা এমন এক জায়গায় শেষ হল, ঘটনাটা পরিণতি পেল না। যদিও এ ধরনের এন্ডিং আসলে এক ম্যাচিউরড স্টাইল, তবে বাচ্চাদের গল্পে এ স্টাইলটা বজায় রাখা যায় না। কারণ ক্ষুদে পাঠকদের এ ধরণের পরিণতি উপভোগ করার যোগ্যতা থাকে না । হুমায়ূন আহমেদের বাচ্চাদের জন্য লেখাগুলোতে তিনি তাই তাঁর এ ধরণের এন্ডিং সচরাচর টানেন নি। ‘মোবারক হোসেনের মহাবিপদ’ ধরণের কয়েকটা গল্প আছে যেগুলোতে এ ধরণের এন্ডিং আছে। যেগুলো আমার মতে শিশুতোষ গল্পের এন্ডিং নয়।
আমাদের দেশে যারা ছোটদের জন্য লিখেছেন তাদের লেখাগুলো খুব বেশি উপদেশমূলক, যা আমার মতে ভালো শিশুসাহিত্যের প্রধান অন্তরায়। শিশুরা সরাসরি উপদেশ গ্রহণ করতে রাজি না, এমনিতেই বাবা-মা তাদের নানা ধরণের উপদেশ বাক্যে জর্জরিত রাখেন। সেখানে গল্পের ভিতরেও প্রত্যক্ষ উপদেশ তারা ভালো চোখে দেখবে না- এটাই স্বাভাবিক। ব্যাপারটা বোঝা যায় একই পরিবারের বাংলা শিশু সাহিত্যের তিন যুগের তিন দিকপাল উপেন্দ্রকিশোর -সুকুমার-সত্যজিৎ রায় এর লেখা বিবেচনা করলে। উপেন্দ্রকিশোরের লেখা দারুণ উপদেশময় ছিল, সুকুমার রায়ের গল্পগুলোতে তার সামান্য অবশিষ্ট ছিল, আর সত্যজিৎ এ ব্যাপারে সবচেয়ে সফল ছিলেন। তাঁর গল্পগুলো পুরোপুরি উপদেশমুক্ত। এ প্রেক্ষাপট থেকে হুমায়ূন আহমেদের শিশুতোষ গল্পগুলো দারুণ সফল, সরাসরি ধরে বেঁধে কোন উপদেশ নেই। কিছু গল্পে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কিছু উপদেশ আছে যেমন, রাণী কলাবতী গল্পে অহংকার করার জন্য তাকে ভুগতে হয়, বনের রাজা গল্পে শিয়ালকে দুষ্টুমির সাজা পেতে হয়।
তাছাড়া আমাদের বাংলা শিশুসাহিত্যে মামা,চাচা, দাদা ( বড় ভাই) বা একটা শিশু বা কিশোর দলের তাদের চেয়ে বড় বয়সী কারো প্রভাবযুক্ত গল্প বেশ প্রচলিত, টেনিদা যেমনটা, লেবু মামা যেমনটা। এই প্রচলিত শিশু-কিশোর গল্পের ফর্ম্যাট থেকে তার অধিকাংশ গল্প মুক্ত, অল্প কিছু অবশ্য আছে। সেগুলোতেও অবশ্য বড়রা প্রভাবক নয়।
পশুপাখি বা পোকামাকড় নিয়ে, মানে যেখানে মানুষের উপস্থিতি নেই বললেই চলে এমন কয়েকটা অসাধারণ গল্প আছে হুমায়ূন আহমেদের। ‘পিপলি বেগম’ এমন একটি গল্প। মশাদের নিয়েও এমন একটা গল্প আছে ‘এক ভয়ংকর অভিযানের গল্প’। তাঁর আর একটি অসাধারণ গল্প ‘ এ কী কাণ্ড’, পুরোপুরি কাল্পনিক একটি প্রাণী নিয়ে দারুণ একটি গল্প।
সব মিলিয়ে হুমায়ূন আহমেদের সব শিশুতোষ গল্পই আশ্চর্য জাদুকরী, তাঁর গল্পের প্রতিটি চরিত্র অদ্ভূত সুখী চরিত্র, নেগেটিভ চরিত্রের বালাই নেই বললেই চলে। এটা আমার কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়, কারন আমাদের দেশে শিশুদের জন্য লেখা আরেক সাহিত্যিক মুহম্মদ জাফর ইকবাল এর শিশুতোষ গল্প এই দোষে কিছুটা দুষ্ট, প্রচুর নেগেটিভ ক্যারেক্টার থাকে।
আরেকটা বৈশিষ্ট্য না বললে হুমায়ূন আহমেদের ছোটদের গল্প আলোচনা অসমাপ্ত থেকে যাবে। তাঁর বড়দের উপন্যাসে তিনি পাঠকদের নানা হাহাকারের মুখোমুখি করেছেন। তাঁর উপন্যাস পড়ে বুকের নিবিড় গভীর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরোয়নি, এমন বাঙালি পাঠক পাওয়া যাবে না।শিশুতোষ গল্পে তার এ লেখনী অন্যভাবে এসেছে।
‘ভূতমন্ত্র’ গল্পে ভূতের রাজার ছেলে বাবলুকে অদৃশ্য হবার মন্ত্র, যেকোন খাবারকে মজার খাবার বানানোর মন্ত্র বা কঠিন অংককে সহজ বানানোর মন্ত্র শেখাতে চায়, কিন্তু বাবলু রেগে গিয়ে কিছুই শোনে না, অনেক অনুনয় করেও তাকে মন্ত্রগুলো খাতায় লেখানো যায় না। কিন্তু চলে যেতেই বাবলু বোঝে মন্ত্র আসলেই আছে। ইশ! কেন লিখে রাখলো না- এই আফসোসে পাঠকের মন ভারী হয়ে যায়।
তার আরেক গল্পে বোকা এবং ভালো দৈত্যকে তার বাবা-মা গভীর সমুদ্রে ফেলে দেয়, মনে আছে এই গল্পগুলো পড়ার সময় কী কষ্টই না লেগেছে। একই ব্যাপার ঘটে সেই দরিদ্র শিক্ষকের জন্য, যার হাতে ছিল পরশ পাথরের মত নিমিষেই অভাব-দৈন্য দূর করার মত বস্তু, কিংবা পানির উপর দিয়ে হাঁটতে পারা এক লোকের জন্য- যে এ ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও জীবনে মাত্র একবারই পানিতে নেমেছে।
আজ হুমায়ূন আহমেদ নেই। এই না থাকাটা যেমন সত্য, তেমনি সত্য এটাও যে - আমাদের দেশের শিশুরা তাদের জন্য মনোমুগ্ধকর আর মন-ভুলাইয়া গল্প বলতে পারতেন এমন কাউকে হারিয়েছে - যার অনেক গল্পই হয়তো ঝুলিতেই রয়ে গিয়েছিল, বের করে দিয়ে যেতে পারেন নি।
এ আফসোসও তার গল্পের মতই আমাদের বুকে নিদারুণ এক হাহাকার তৈরি করে যাবে আজীবন।

দ্য কিউরিয়াস ইনসিডেন্ট অব দ্য ডগ ইন দ্য নাইট টাইম


সম্প্রতি পড়া মনের উপর প্রভাব ফেলা অন্যতম একটা বই। ব্রিটিশ লেখক মার্ক হ্যাডন ২০০৩ সালে বইটি লিখে আলোচনায় আসেন, বোয়েক প্রাইজ, হুইটব্রেড প্রাইজ,কমনওয়েলথ রাইটারস প্রাইজ ফর বেস্ট ফার্স্ট বুক সহ অনেক অনেকগুলো পুরস্কার অর্জন করে, এছাড়া ম্যান বুকার প্রাইজের লংলিস্টে ছিল।
বইটা এক কিশোরের ফার্স্ট পারসন পয়েন্ট অব ভিউ থেকে বর্ণিত হয়েছে, ক্রিস্টোফার নামক এ কিশোরটি অটিজম বা স্যাভান্ট সিন্ড্রমে আক্রান্ত, তবে লেখক এটা পরিষ্কার করে না। আমার কাছে মনে হয়েছে অটিজম।অটিস্টিক শিশুরা কিভাবে চিন্তা করে সেটা এখনো বেশ ধোঁয়াশাপূর্ণ মেডিকেল সায়েন্সে, লেখক যদিও স্বীকার করেছেন তিনি এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন, তবে ক্রিস্টোফারের চিন্তাভাবনা পড়ে মনে হয়- হয়তো এভাবেই তারা চিন্তা করে।
বইটা শুরু হয় একটা রহস্য উপন্যাসের মত করে, ক্রিস্টোফারের এক প্রতিবেশীর কুকুরের খুন হওয়া এবং সেটার রহস্য উদঘাটনে ক্রিস্টোফারের তদন্তে নামা দিয়ে। তবে এটা মোটেও রহস্য উপন্যাস না, এ ধরনের উপন্যাসকে হয়তো নীরিক্ষাধর্মী বলা চলে যেগুলো আসলে জনরায় ফেলা বেশ কঠিন।
ক্রিস্টোফারের চিন্তাগুলো বেশ ইন্টারেস্টিং এবং যৌক্তিক। কিছু কিছু চিন্তায় বেশ চমকে উঠতে হয়।
যেমন ক্রিস্টোফার মিথ্যা বলতে পারে না। এটার ব্যাখ্যা সে এভাবে দিয়েছে-
‘মানুষ যখন মিথ্যা বলে তখন সে এমনকিছু বলে যেটা আসলে ঘটেনি। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় কেবলমাত্র একটি ঘটনাই ঘটতে পারে, কিন্তু ঘটেনি এমন ঘটনার সংখ্যা অসীমসংখ্যক হতে পারে। তাই আমি যদি এমন কিছু বলতে চাই যা ঘটেনি, তাহলে অন্যান্য সেই অসীম সংখ্যক ঘটনা যা ঘটেনি নিয়ে ভাবতে থাকি।’
ক্রিস্টোফারের জীবন নিয়ে ভাবনাটা চমৎকার।সে মানুষের অনেক কিছুই বোঝে না, কি কারনে মানুষ মিথ্যা বলে জোক করে সেটাও তার কাছে রহস্য। তার দৃষ্টিতে
‘জীবন হচ্ছে মৌলিক সংখ্যার মত, সেটা খুবই যৌক্তিক, কিন্তু তাদের ভেতরের নিয়মটা কখনোই বের করা যায় না, যদি তুমি সারাদিন সারারাত চিন্তা করো তারপরও না।’
ভালবাসার সংজ্ঞাও তার কাছে বেশ সহজ সরল-
তার বাবা তাকে জিজ্ঞেস করে, ক্রিস্টোফার আমি তোমাকে ভালবাসি এটা কি তুমি বুঝতে পারো।
এ প্রশ্নের জবাবে ক্রিস্টোফার এর ভাবনা-
And I said "Yes," because loving someone is helping them when they get into trouble, and looking after them, and telling them the truth, and Father looks after me when I get into trouble, like coming to the police station, and he looks after me by cooking meals for me, and he always tells me the truth, which means that he loves me.”

ক্রিস্টোফার তার সারল্যে সবকিছু বিচার করে যুক্তি দিয়ে, তখন আমাদের হয়তো মনে হতে পারে- যুক্তিবাদ কি এক ধরনের সারল্য। কিংবা সত্য কি যুক্তির মত!
এরকম ছোট ছোট চিন্তা-ভাবনা ছাড়াও ক্রিস্টোফারের গণিত ও বিজ্ঞান নিয়ে, নানা পাজল নিয়ে চিন্তাভাবনা রয়েছে- ক্রিস্টোফার গণিত ভালবাসে-তাই বাইরের পৃথিবী যখন তার অসহ্য মনে হয় তখন সে দ্বিমাত্রিক বা ত্রিমাত্রিক নানা ইকোয়েশন নিয়ে চিন্তা করে, কখনো কোন কোন বিখ্যাত সমস্যা নিয়ে সময় পার করে দেয়।
এরকম ছোট ছোট দর্শন, চিন্তাভাবনা বইটাতে কোন জটিল প্লট না থাকা সত্ত্বেও সুখপাঠ্য করে তুলেছে এবং এক অটিস্টিক কিশোরের দৃষ্টিতে বাস্তত জগতের যুক্তিহীন কিছু ব্যাপারের সমালোচনাও উঠে এসেছে।

আরো কিছু ভাললাগা উক্তি( আমি টাইপ করিনি, গুডরিডস থেকে কপি পেস্ট করলাম)-
-“maths wasn't like life because in life there are no straightforward answers in the end”
- Siobhan said that when you are writing a book you have to include some descriptions of things. I said that I could take photographs and put them in the book. But she said the idea of a book was to describe things using words so that people could read them and make a picture in their own head.
- And people who believe in God think God has put human beings on the earth because they think human beings are the best animal, but human beings are just an animal and they will evolve into another animal, and that animal will be cleverer and it will put human beings into a zoo, like we put chimpanzees and gorillas into a zoo.
- I like dogs. You always know what a dog is thinking. It has four moods. Happy, sad, cross and concentrating. Also, dogs are faithful and they do not tell lies because they cannot talk.

সিজারিয়ান সেকশন না নর্মাল ডেলিভারি : আপনি কিভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন, আপনার ডাক্তার কিভাবে সিদ্ধান্ত নেয় এবং স্বাস্থ্য গবেষকরা কি বলে?

সন্তান জন্মদান প্রক্রিয়া যে কারনেই হোক মানুষের ক্ষেত্রে এখনো একটা ঝুঁকিময় কাজ, সন্তান জন্মদিতে গিয়ে বহু মা এই আধুনিক যুগেও মারা যাচ্ছে। বাইবেলের একজায়গায় বলা আছে, ঈশ্বর আদি পাপের জন্য নারীদের অভিশাপ দিয়েছে তাদের সন্তান জন্মদান কষ্টকর হবে। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, অভিশাপটা লেগে গেছে (ঈশ্বরের অভিশাপ বলে কথা!)। মানুষের মত এত ঝামেলা অন্য কোন প্রাণীকে পোহাতে হয় না। আরেকটা ব্যাখ্যা হল (পাপিষ্ঠ নাস্তিকদের ব্যাখ্যা) মানুষের বিবর্তন ঠিক ভাবে হয় নাই। বার্থ ক্যানেলের তুলনায় গর্ভস্থ সন্তানের মাথার আকৃতি বড় এখনো। এতবড় মাথার সন্তানের জন্মদানে বৃহৎ হিপ দরকার, কিন্তু হাঁটাচলার জন্য সরু হিপ প্রয়োজন, এই অবসটেট্রিকাল ডাইলেমার ( obstetrical dilemma) কারনে প্রতি ১০০০ মানব প্রসূতি এর অন্তত একজনের বাচ্চার মাথা বার্থ ক্যানেল দিয়ে বের হওয়া সম্ভব না। এসব ক্ষেত্রে আধুনিক চিকিৎসা প্রচলিত হওয়ার আগে মা বা শিশু বা উভয়ই মৃত্যুবরণ করতো।
এসব কারনে অন্য যেকোন প্রাণীর তুলনায় মানুষের জন্মদান প্রক্রিয়া বহুগুণ পেইনফুল। দেখা যায়, প্রথম বার সন্তান জন্মদানকারী মায়ের গড়ে ৯ ঘন্টা লেবার পেইন সইতে হয়, মানুষের কাছাকাছি অন্যান্য এপদের জন্য এ সময়টা মাত্র ২ ঘন্টা।
এবার আসি সিজারিয়ান অপারেশন নিয়ে। এটা নি:সন্দেহে দারুণ একটা অপারেশন, গর্ভজনিত জটিলতার সর্বাধুনিক সমাধান। প্রথমে এটা প্রচলিত ছিল মূলত মায়ের জীবন রক্ষার্থে। তারপরও বেশ কম হত এটা, কারন কয়েকদশক আগেও ব্লাড ট্রান্সফিউশনের ভাল ব্যবস্থা ছিল না, অ্যানেস্থিশিয়া উন্নত ছিল না, ইনফেকশন প্রতিরোধের ব্যবস্থাও ভাল ছিল না। তাই সিজারিয়ান অপারেশনও বেশ রিস্কি ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে এটা একটা নিরাপদ অপারেশন হয়ে যায়, ইন্টার্নির সময় দেখেছি স্যার-ম্যাডামরা এটাকে পাত্তাই দেয় না, এমনকি অনেক ইন্টার্নও এ অপারেশন করার অনুমতি পায়। ভাল অ্যানেস্থিশিওলজিস্ট, ভাল ওটি, প্রয়োজনীয় রক্ত ও ঔষধ যোগাড় থাকলে গাইনী ও অবস্ এর ডাক্তারদের জন্য এটা আসলেই বেশ ছোট ও নিরাপদ অপারেশন।
তারপরও কথা থাকে, যতই নিরাপদ হোক প্রাকৃতিক উপায়ে নর্মাল ডেলিভারীর অপশন আমাদের অবশ্যই প্রথমে ভাবা উচিত, কারন একটা অপারেশন অপারেশনই। সেটাতে ইনফেকশনের ভয় থাকবেই, অ্যানেস্থেটিক হ্যাজার্ডের চান্স থাকবেই, নর্মাল ডেলিভারীতে মা যেখানে একদুইদিন পরই সুস্থ-স্বাভাবিক ভাবে হাঁটা-চলা করতে পারে, সেখানে সিজারিয়ান অপারেশন হওয়া মাকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য অন্তত দেড়মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলা হয়, ভারী কাজ করতে নিষেধ করা হয় তিনমাস পর্যন্ত।
তাই কিভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় নর্মাল না সিজারিয়ান সেটা জানা জরুরী সবার। এটা সম্পর্কে ধারণা না থাকায় ইদানিং দেখছি ডাক্তার এবং প্রসূতি এর পরিবারের সাথে মনোমালিন্য হয়, কেউ ভাবে প্রয়োজন ছাড়াই বোধহয় সিজারিয়ান করা হচ্ছে, আবার কোন প্রসূতির নর্মাল ডেলিভারী হওয়া সম্ভব বা উচিত সেও ভয় পেয়ে সিজারিয়ান করাতে চায়। আর ক্লিনিকগুলো তো ওৎ পেতে থাকে কখন অপারেশন করে পয়সা হাতানো যায়।
মোটা দাগে কখন সিজারিয়ান করাতে হবে তার লিস্ট:
১. প্রাইমিগ্রাভিডা ( প্রথম সন্তান হচ্ছে এমন মা) তে যদি বাচ্চা উল্টা থাকে বা ব্রিচ প্রেজেন্টশনে থাকে ( আল্ট্রাসনোগ্রাম এ বোঝা যায়) এবং তার সাথে যদি আর কোন সমস্যা থাকে।
২. বাচ্চার জন্মের ঠিক আগে আগে করা আল্ট্রাসনোতে যদি বাচ্চা ট্রান্সভার্স বা আড়াআড়ি অবস্থানে থাকে। ( ভার্টিকাল বা সোজা থাকার কথা)
৩. এর আগে জন্মদান সংক্রান্ত জটিলতা হয়ে থাকার হিস্ট্রি আছে।
৪. প্রসূতির যদি সেফালোপেলভিক ডিসপ্রপোরশন থাকে ( মানে গঠনগত বিষম অনুপাত)। এটা গাইনোকলজিস্ট যাচাই করে বুঝতে পারবে।
৫. প্লাসেন্টা প্রিভিয়া বা প্লাসেন্টা যদি সঠিক অবস্থানে না থাকে। ( আল্ট্রাসনোতে বোঝা যায়)
৬. এর আগে যদি ইউটেরাস রাপচার বা পারফোরেশন হওয়ার হিস্ট্রি থাকে।
৭. এর আগে দুইবারের অধিক সিজারিয়ান অপারেশন হয়ে থাকে যদি।
৮. দীর্ঘ সময়ের বন্ধ্যাত্ব থাকার পর প্রথম সন্তান জন্মের ক্ষেত্রে
৯. ডায়াবেটিস জনিত জটিলতা সহ ডায়াবেটিক প্রসূতি হলে
১০. এর আগে ভেসিকো ভ্যাজাইনাল ফিস্টুলার অপারেশন হয়ে থাকলে
১১. প্রসূতির সারভাইকাল ক্যান্সার ধরা পড়লে
১২. পেলভিক টিউমার থাকলে


এসব ক্ষেত্রে ডাক্তার আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখতে পারে সিজারিয়ান সেকশনের। কিন্তু এমনও হতে পারে, প্রসূতির কোন সমস্যা দেখা গেল না, তাই নরমাল ডেলিভারির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে, কিন্তু জন্মদানের সময় নতুন কোন জটিলতা দেখা দিল। তখনও ইমার্জেন্সি সিজারিয়ান সেকশন করা লাগে। এমন কিছু পরিস্থিতি হল-
১. বাচ্চার হার্টরেট অস্বাভাবিক হলে ( ডাক্তার স্টেথোস্কোপ দিয়ে বুঝতে পারবেন)
২. দীর্ঘ সময় ধরে ব্যথা ওঠা সত্ত্বেও ( ১৮ ঘন্টার বেশি) বাচ্চা না প্রসব হলে
৩. অবস্ট্রাকটেড লেবার ( ইউটেরাসের নর্মাল কন্ট্রাকশন থাকা সত্ত্বেও কোন মেকানিকাল অবস্ট্রাকশন যেমন সরু পেলভিস, বাচ্চার পজিশন সঠিক না থাকা বা অন্যকোন কারনে প্রসব অগ্রসর হচ্ছে না বোঝা গেলে)
৪. কর্ড প্রলাপস বা আম্বলিকাল কর্ড বাচ্চার আগেই বের হয়ে আসলে
৫. একলাম্পশিয়া ডেভেলপ করলে ( উচ্চ রক্তচাপ ও খিঁচুনি, কখনো এর সাথে প্রসূতি অজ্ঞান হয়ে যায়)
৬. ব্রো প্রেজেন্টেশন অর্থাৎ বাচ্চার মাথা সাধারণত জন্মের সময় বুকে লেগে থাকে, সেটা না হয়ে যদি ঘাড়ে লেগে থাকে ( মানুষ উপরের দিকে তাকালে যেমনটা হয়) তাহলে সিজারিয়ান সেকশন লাগতে পারে।
৭. অতিরিক্ত রক্তপাত
৮. অ্যামনিওটিক ফ্লুইড ( যে তরলে বাচ্চা ভেসে থাকে, পানি ভাঙলে যে তরলের উপস্থিতি বুঝতে পারেন প্রসূতি) এর তারতম্য ধরা পড়লে।


এবার কিছু প্রশ্নোত্তর।

প্রশ্ন: আমাদের দেশে সিজারিয়ান সেকশন এর পরিমান বেড়ে গেছে অনেক, এর কারন কি?

পুরো বিশ্বেই আসলে সিজারিয়ান সেকশন অনেক বেড়ে গেছে মূলত সার্জারির সফলতা বাড়ার কারনে। আমাদের দেশে কয়েকদশকে শতকরা বিশভাগ বেড়েছে এই অপারেশন। ইংল্যান্ডে প্রতি চারজন প্রসূতির একজনের সিজারিয়ান সেকশন হয় মানে প্রায় ২৫ ভাগ। (সূত্র: বিবিসি), আমেরিকায় সেটা প্রায় ৩৩ ভাগ (সূত্র ) । সাইপ্রাসে ৫০ ভাগ শিশু জন্ম নেয় সিজারিয়ানে! অবশ্য ইউরোপের অনেক দেশে এ হার বেশ কম। যেমন- নেদারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড ইত্যাদি কয়েকটি দেশে মাত্র ৬ থেকে ৭ ভাগ শিশু সিজারিয়ান অপারেশনে জন্ম নেয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষকরা বলেন একটা দেশে শিশু ও মায়ের মৃত্যু কমাতে অন্তত ১৫ ভাগ সিজারিয়ান সেকশন হওয়া উচিত, এর বেশি হলে সেটা মৃত্যু হার কমাতে কোন সহায়তা করে না। আমেরিকান গাইডলাইন মতে অন্তত ১৯ ভাগ সিজারিয়ান সেকশন হওয়া উচিত যেকোন জনপদে।
এর বেশি হলে সেটা মোটেও কোন উপকার বয়ে আনে না। বরঞ্চ উল্টো প্রসব পরবর্তী জটিলতা বাড়াতে পারে।
আমাদের দেশে মূলত যেসব কারনে এ অপারেশন বেড়ে যাচ্ছে তার উল্লেখযোগ্য কারন হল
- নরমাল ডেলিভারির ব্যাপারে ভীতি
- নরমাল ডেলিভারি অনিশ্চিত, কখন হবে ঠিক নাই। এ অনিশ্চয়তা অনেকে পছন্দ করে না বিশেষত কর্মজীবি নারীরা।
- জন্মের আগে বাচ্চার অবস্থা যাচাই করার সুবিধা বৃদ্ধি পাওয়া, এ ব্যাপারে মানুষের সতর্কতা বৃদ্ধি পাওয়া
- অপারেশন করতে সক্ষম হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া


প্রশ্ন: ডাক্তাররা কিভাবে সিদ্ধান্ত নেয়?
ডাক্তারদের উপর করা এক সমীক্ষায় ( ইউ এস এ তে) তারা কবুল করেছে- কোন ধরনের সমস্যা মনে হলে তারা সিজারিয়ান সেকশনে চলে যেতে চান কেননা এরপর কেউ অভিযোগ করলে তারা যেন বলতে পারেন, তিনি সর্ব্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। কারন নর্মাল ডেলিভারিতে কোন সমস্যা হলে ডাক্তার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারেন কেন তিনি সিজারের কথা ভাবেন নাই।
তাছাড়া অনেক রোগীই নিজ থেকেই আগ্রহ দেখান সিজারিয়ান সেকশনে, সেক্ষেত্রে তাদের নিবৃত্ত করা যেকোন ডাক্তারের জন্য রিস্কি হয়ে যায়।

প্রশ্ন: আপনি কিভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন?
প্রসূতির উপরের কোন রিস্ক আছে কিনা সেটা জানতে তাকে রেগুলার চেকআপ এবং একজন প্রসূতিবিদের পরামর্শে থাকতে হবে। প্রসূতিবিদের সাথে খোলামেলা আলোচনা করে নেয়া উচিত, কোন রিস্ক থাকলে সেটা কি ধরনের সেটা বোঝা উচিত। কোন ধরনের রিস্ক না থাকলে ( যেটা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, রিস্ক থাকার সম্ভাবনা মাত্র শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগ) আপনারা যে নর্মাল ডেলিভারি করাতে চান সেটা তাকে জানান।

প্রশ্ন: দেশের ক্লিনিকগুলো কিভাবে সিদ্ধান্ত নেয়?
এটার উত্তর খুবই সহজ। কিছু ব্যতিক্রম বাদে অধিকাংশ ক্লিনিক হচ্ছে টাকা কামানোর প্রতিষ্ঠান। সিজারিয়ান সেকশনে তাদের ভাল অর্জন হয়, তারা যথেষ্ট ভাল প্রসূতিকেও সিজারিয়ান সেকশন করানোর জন্য চেষ্টা করাতে পারে। প্রসব ব্যথা নিয়ে সরাসরি যারা যে সে ক্লিনিকে গিয়ে হাজির হয় তারা এর ভিকটিম হতে পারে।
উচিত হল, ভাল কোন প্রসূতিবিদ ডাক্তারের পরামর্শে থাকা, নিয়মিত চেক আপ করানো এবং তার পরামর্শ অনুযায়ী হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ভর্তি হওয়া।


তথ্যসূত্র: ক্লিনিক্যাল গাইড টু অবসটেট্রিকস এবং গাইনোকোলজি-প্রফেসর সাইয়েদা নূরজাহান ভুইঁয়া, বিবিসি, স্ট্যাট নিউজ,WHO ওয়েবসাইট

পণ্যের বিজ্ঞাপন থেকে যে কারণে মূল্যবোধ শিক্ষার আশা করা ভুল!

আমরা নানা পণ্যের বিজ্ঞাপন দেখে মাঝে-মধ্যেই হতাশ হই, অনেকে হা-হুতাশ করে বলে এই অ্যাড দেখে লোকে কি শিখবে, আজকেও একজনের দীর্ঘ স্ট্যাটাস পড়লাম যে কোন এক বিজ্ঞাপনে নারীদের গৃহস্থালি কাজের আবশ্যক হিসেবে দেখানোতে তার আঁতে লেগেছে, এটা নাকি আমাদের ভুল দিকে গাইড করতে পারে বা এতে নারীদের অসম্মান হতে পারে। কিন্তু অ্যাড থেকে কোন মূল্যবোধ আশা করাটা একদমই গোড়ার গলদ। বিজ্ঞাপন কখনই শিক্ষার উপকরণ না, বিজ্ঞাপন থেকে কখনোই কিছু শেখা যাবে সেটা আশা করা ঠিক না, যদি যায় সেটা বাড়তি পাওনা, কিন্তু না শেখা গেলে সেটা বিজ্ঞাপনের ব্যর্থতা না।
সেদিন একটা বইয়ে পড়ছিলাম শত শত বছর ধরে পণ্যের প্রসারের জন্য কিভাবে বিজ্ঞাপনে মিথ্যা তথ্য দেয়া হয়। পেপসোডেন্ট এর বিজ্ঞাপনকে বলা হয় বিজ্ঞাপণের একটি সোনালী উদাহরণ, আঠার শতকে আমিরিকানরা দাঁত মাজতো না ( সিরিয়াসলি, তারা এটার প্রয়োজনই অনুভব করতো না), সেসময় যদিও বেশ কয়েকটি টুথপেস্ট কোম্পানি ছিল কিন্তু কেউ তাদের পণ্যকে প্রচলিত করতে পারেনি। পেপসোডেন্ট তখন কিছু বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে দারুণ ভাবে সফল হয়, তাদের সফলতার একটা কারণ ছিল তাদের পেস্টে অ্যাসিডিক কিছু এলিমেন্ট ছিল যার কারনে দাঁত মাজার পর মুখ জ্বলতো এবং একটা কৃত্রিশ ফ্রেশ ভাব আসতো, অন্য টুথপেস্টগুলোর উপকারী উপাদান একই থাকা সত্ত্বেও তারা আমেরিকানদের দাঁত পর্যন্ত উঠতে পারে নাই। পেপসোডেন্ট তাদের এই অপ্রয়োজনীয় অম্লীয় উপাদানজাত ফ্রেশনেসকে কাজে লাগায়, যা একটা মিথ্যাচার। এমনকি আজকে দুনিয়ার তাবৎ টুথপেস্ট কোম্পানী এইসব উপাদান ব্যবহার করে মানুষকে কৃত্রিম এই ফ্রেশনেস দেয়ার জন্য। হরলিকস, কমপ্ল্যানের মত কোম্পানীগুলোর দেয়া প্রত্যেকটি তথ্যই মিথ্যা- সেটা অনেকেই জানে, শ্যাম্পু বা ডিটারজেন্টে যে ফেনা তৈরি হয় তা চুল বা কাপড় পরিষ্কারের জন্য একদমই প্রয়োজন নেই, ফোন কোম্পানীগুলো দেশপ্রেম জাতীয় যেসব অনুভূতি নিয়ে কাজ করে সেটা বিদেশী কোম্পানীর মূল অনুভূতি নয় সেটা কে না জানে, এসব নানা মিথ্যাচারই পন্য উৎপাদনকারীর টিকে থাকার হাতিয়ার- তাদের বেশি দোষ দিয়ে লাভ নাই।
বিজ্ঞাপন আসলে মানুষ যা চায় তাই প্রচার করে। আজকে ফেয়ার এন্ড লাভলি ফর্সা ত্বকের প্রচারণা চালাচ্ছে তারমানে এই না, তারা ফর্সা ত্বক ভাল সেটা নতুন করে বলছে, উপমহাদেশের মানুষ মনে করে ফর্সা চামড়া সুন্দর তাই সেটাই তারা ব্যবহার করছে। সাহিত্য সমাজের দর্পণ কিনা আমি শিওর না, কিন্তু বিজ্ঞাপন অবশ্যই সমাজের দর্পণ। নারীকে গৃহস্থালী কাজে বিজ্ঞাপন মোটেও উৎসাহ দিচ্ছে না, এদেশের অধিকাংশ নারী গৃহস্থালী কাজে নিয়োজিত সেটাকেই তারা ব্যবহার করছে।
এটা ঠিক পণ্যের বিজ্ঞাপন সবসময় মিথ্যাচার করে না, তবে প্রয়োজন হলেই করে- মূল কথা হল তারা তাদের টার্গেট কাস্টমারদের চাহিদা অনুযায়ী তথ্য সরবরাহ করে।
নৈতিকতা, লিঙ্গ বৈষম্য এসব নিয়ে সচেতনতা তৈরি করা মিডিয়ার দায়িত্ব সেটা ঠিক, নৈতিকতা টার্গেট করে সরকারি নানা প্রচারণা, নানা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এর জনসচেতনতা মূলক কাজ, ভাল পরিচালকের নাটক সিনেমা, ডকুমেন্টরি বা ডকুড্রামা, ভাল গল্প-উপন্যাস এ দায়িত্ব পালন করে-কারন এসব নির্মাতা গল্পকারদের নিজস্ব দর্শন থাকে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উদ্দেশ্য থাকে।
কিন্তু একটা পণ্যের বিজ্ঞাপনের কি উদ্দেশ্য থাকে, কি দর্শন থাকে- তার পণ্যের প্রচারণা-শুধুমাত্র এটিই। আমার একটি পন্যনির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান থাকলে আমি যখন বহু খরচ করে একটা বিজ্ঞাপন দেব সেখানে আমি নৈতিকতা প্রচারের বিলাসীতা করবো না, আমি চাইবো আমার টার্গেট কাস্টমারদের কিভাবে কনভিন্স করা যায়।
তবে হ্যা, আমি তখনই আমার আমার বিজ্ঞাপনে নৈতিকতা বা দেশপ্রেমের মত অনুভূতিকে প্রচার করবো যখন দেখবো আমার টার্গেট দর্শক-সমাজে নৈতিকতা, দেশপ্রেম খুব গুরুত্ব পাচ্ছে। তখন তাদের টানতে আমি সেসবের প্রচারণা চালাতে পারি।
উন্নত দেশে মিথ্যাচার করা বিজ্ঞাপনের সংখ্যা কমে যাচ্ছে তার একটা কারন হতে পারে, মানুষ সচেতন থাকায় মিথ্যা তথ্য পরিবেশন তার পণ্যের প্রসারের জন্য বরঞ্চ নেগেটিভ হয়ে যেতে পারে।

তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম :: সত্যজিৎ রায়ের স্বল্প আলোচিত অসাধারণ এক কাজ!


সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা আর শঙ্কুর ভিড়ে অতি অসাধারণ এক কাজকে ইদানিং কেউ খুব একটা স্মরণ করে না। এবং তার অন্য লেখায় হিউমারের বেশ স্বল্পতা যেখানে লক্ষ করা যায়, সেখানে এই বইটিতে সেটা যে পরিমানে আছে তা একাই যেন সে খামতিকে পূরণ করে দেয়।
বাংলায় অর্থ-অপ্রধান সাহিত্য বা ননসেন্স ধারাকে জনপ্রিয় করেছেন সুকুমার রায়। আর তারই সুযোগ্য পুত্র সত্যজিৎ রায় পশ্চিমের অসাধারণ কিছু ননসেন্সকে অনুবাদের মত বড় একটি কাজ করে গেছেন। সত্যজিৎ তার পিতার কিছু ছড়াকে ইংরেজিতে রুপান্তর করেছেন, তেমনি ননসেন্স সাহিত্যের দিকপাল এডওয়ার্ড লিয়ার বা লুইস ক্যারলের বেশ কিছু কাজ বাংলায় পাল্টেছেন- পাল্টেছেন বলাই ভাল, কারন এসবের অনুবাদ ঠিক হয় না, মূলভাবটা নিয়ে তিনি নিজের মত করে লিখেছেন সেটা বইয়ের শুরুতে তিনিও কবুল করেছেন। লিয়র লিখেছেন অসংখ্য লিমেরিক, মানে পাঁচ বাক্যের ছড়া- সাথে এঁকেছেন ছবি। সত্যজিৎ সেই ছবিগুলো রেখে আনকোরা বাংলায় রূপান্তর করেছেন অদ্ভূত কিছু লিমেরিক। লিয়রের jumblies অবলম্বনে পাপাঙ্গুল, কিংবা ডং উইথ লুমিনাস নোজ এর যে বিস্ময়কর অনুবাদ তিনি করেছেন সেগুলো মৌলিক বলাই যৌক্তিক।লুইস ক্যারলের বিখ্যাত জবরওয়াকি সহ বেশ কয়েকটা ছড়ার অনুবাদও একই ভাবে তিনি করেছেন।
এসব পড়লে মনে হয়- সত্যজিৎ চাইলেই তার পিতার মত ছড়ার জগতকেও মাতিয়ে রাখতে পারতেন। সুকুমারের আবোল তাবোলের যে বিদায়ী করুণ বাক্যদ্বয়-
‘ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর
গানের পালা সাঙ্গমোর’
ঠিক তার আগের লাইনই ছিল
‘আদিম কালের চাদিম হিম,
তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম’
সেই আবোল তাবোলের ধারাবাহিকতাই ধরে রাখার জন্যই হয়তো সত্যজিৎ বইয়ের নামটাও সেখান থেকে নিয়েছেন- অন্তত আমার তাই মনে হয়েছে।

বইটির সবচেয়ে জনপ্রিয় অংশ বোধহয় ৫ পদী লিমেরিক। এই লিমেরিকের চর্চা বাংলায় খুব একটা হয়নি, অবশ্য পাঁচ বাক্যের সীমাবদ্ধতা নিয়ে খুব বেশি চর্চাতে হয়তো সায় মেলেনি আমাদের ছড়াকারদের।
লিয়রের যে লিমেরিকগুলো এ বইতে সত্যজিৎ অনুবাদ করেছেন, সেগুলোর মূল ইংরেজি পড়ে আমার মনে হয়েছে- অনুবাদ মূল ভার্সনের চেয়ে অধিকাংশই ভালো হয়েছে। এর মানে হয়তো এটা হতে পারে, বাংলা ভাষা লিমেরিকের জন্য আরো উপযুক্ত। হয়তো ভবিষ্যতে কোন ছড়াকার এ ব্যাপারে আরো কাজ করবেন। এ বইয়ের কয়েকটা লিমেরিক এখানে তুলে দিলাম পাঠকদের জন্য


বইটাতে লিমেরিক ছাড়াও বেশ কয়েকটা বড় বড় অনুবাদ ছড়া আছে, পড়লেই বোঝা যায় এগুলো অনুবাদের চেয়েও বেশি কিছু। নমুনা হিসেবে কয়েকটা ছড়া না দিয়ে পারছি না।
লুইস ক্যারলের একটি ছড়ার অনুবাদ-‘মেছো গান’ নামে রয়েছে বইটিতে,ছড়াটা ভীষণ প্রিয় আমার-

শীতকালেতে গাছের পাতা পড়বে যখন ঝরে
গানটা আমি গাইবো তোমার কানে
বসন্তেতে সবুজ কচি ধরলে গাছের পরে
তোমায় ডেকে বলবো গানের মানে
গ্রীষ্মকালে গায়ের মাটি উঠবে যখন তেতে
গানের মানে ঢুকবে তোমার মাথায়
শরৎকালের সোনার ফসল ফললে পরে ক্ষেতে
গানটা লিখে রাখতে পারো খাতায়।

তবে শোনো-
মাৎলার উত্তরে আছে যত মৎস্যেরা
পত্তর লিখে দিনু শুনো ওহে বৎসেরা
মৎসের বৎসেরা খৎ পাওয়া মাত্তর
উত্তর দিল মোরে সত্বর সত্বর

জবাবেতে বললে তারা অবাক করে মোরে-
তুমি যেটা বলছো সেটা করবো কেমন করে?
আমি তখন পালটা তাদের দিয়ে দিলাম জবাব-
করতে হবেই।ভেবেছ কী? তোমরা বুঝি নবাব?
এবার তারা মুচকি হেসে জানায় মোরে লিখে-
মেজাজ যদি দেখাও তবে পড়বে বেগতিকে।

এই হবে উত্তর কেউ কি তা জানতো
ধুত্তর বলে তাই করি চক্রান্ত।
কংসের পাত্তর নিয়ে যাই কলেতে
রাত্তির হলে পরে ভরি তায় জলেতে।
এমন সময় এক বুড়ো এসে বলে-
মাছেরা যে ঘুম দেয় ডাঙাতে।
আমি বলি চট করে যাও দিকি চলে
দেখো যদি পার ঘুম ভাঙাতে...


বইয়ের প্রিয় আর একটি ছড়া আদ্যি বুড়োর পদ্যি, এটা লুইস ক্যারলের হোয়াইট নাইট সং অবলম্বনে লেখা-

বলবার আছে যা বলি আজ তোরে
(বলবার বেশি কিছু নেই)
দেখেছিনু বুড়ো এক ফটকের পরে
সব্বার ত্থুথুড়ে যেই।

আমি তারে শুধোলোম, বুড়ো তুই কে রে?
দিন তোর কাটে কোন কাজে?
জবাবেতে বুড়ো কথা বলে তেড়েমেড়ে
মোর কানে কিছু ঢোকে না যে

বুড়ো বলে ধরি আমি ফড়িং এর ছানা
যেই ছানা ঘুম দেয় মাঠে
তাই দিয়ে রেধে নিয়ে মোঘলাই খানা
ফেরি করি গঞ্জের হাটে

সেই খানা খেয়ে নিয়ে খালাসির বেটা
পাড়ি দেয় সাগরের জলে
এই করে কোনমতে খেয়ে আধপেটা
কায়ক্লেশে দিন মোর চলে

বুড়ো বকে, আমি পড়ি চিন্তার ফেরে
দাড়ি যদি হয় কারো সবুজই
থুৎনির সামনে হাতপাখা নেড়ে
সেই দাড়ি ঢাকা যায় না বুঝি?

বুড়ো দেখি চেয়ে আছে কাঁচুমাচু মুখে
আমি ভাবি কী যে বলি তারে
তারপর মেরে এক কিল তার বুকে
বলি- বল আয় কিসে বাড়ে

বুড়ো বলে শোনো আমি পাহাড়ের বুকে
খুজেঁ ফিরি ঝরণার জল
সেই জল পেলে পরে চকমকি ঠুকে
চট করে জ্বালি দাবানল

....
এদিকে আমি ভাবি আর সব ছেড়ে
খাই যদি শুধু পাটিসাপটা
ওজনটা দিন দিন যাবে নাকি বেড়ে?
বাড়বে না উদরের মাপটা?
....
( পুরো টুকু দিলাম না, ছড়াটা বেশ বড়)

ছড়াগুলো পড়লে মনে হবে কোন অর্থ নেই, কিন্তু অন্য রকম এক হাস্যরস বা রোমাঞ্চ লুকিয়ে আছে লাইনে লাইনে। এটাই হয়তো ননসেন্স এর গুণ। ছেলেবেলায় আমরা সবাই যেমন নানা ননসেন্স রাইমে মজে থাকতাম, সেরকমই একধরনের ভালো লাগা জুড়ে থাকে পড়ার সময়।

ছড়াপ্রেমী এবং সত্যজিৎ অনুরাগীদের অবশ্যপাঠ্য একটা বই!

কোহিনূর এর আসল মালিক কে? চলুন দেখি এর রোমাঞ্চকর ইতিহাস কি বলে!


বিখ্যাত হীরা কোহিনূরের মালিকানা নিয়ে আবারও সরব হয়ে উঠেছে সংবাদমাধ্যম। ভারত এখন বলছে, এটা নাকি ইংরেজদের উপহার হিসেবেই দিয়েছিল তারা। সত্যিই কি তাই?
বছরের পর বছর কোহিনূরকে নিজেদের সম্পদ বলে ব্রিটিশদের চুরি আর লুটতরাজের অভিযোগে জর্জরিত করে এসেছে ভারত। ব্রিটিশদের কোনো হোমড়াচোমড়া ব্যক্তি ভারত সফরে এলেই ‘আমাদের হিরেটা কিন্তু এখনো আপনাদের পকেটে দাদা’ বলে হরহামেশাই বিব্রত করেছে। কিন্তু ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কিনা হাত কচলে বলে ফেলল—হিরেটা আমরা স্বেচ্ছায় ব্রিটিশদের উপহার দিয়েছিলাম, ওর প্রতি আমাদের আর দাবি নেই!’ তখন চোখ কপালে তোলাই দস্তুর। আসলেই কি কোহিনূর স্রেফ উপহার হিসেবে ভারত থেকে বিলেতে গিয়েছিল? নাকি দাবি করে পাওয়া যাবে না বুঝতে পেরে ভারত সরকার কপট পুণ্যার্থীর মতো দানের মহত্ত্বে কোহিনূরের মালিক হতে চাইছে। সেটা হয়ে থাকলে এ এক মোক্ষম চালাকিই বটে। কেননা কোহিনূরের দাবিদার তো ভারত একাই নয়। শেষবারে উপমহাদেশের যে অংশে কোহিনূর তার জ্যোতি ছড়াচ্ছিল, সেটা ছিল শিখ সাম্রাজ্য লাহোর। তাই পাকিস্তানের দাবির জোরও কিন্তু বেশি বই কম নয়। আবার কোহিনূরের নাম রাখিয়ে সম্রাট নাদির শাহর দেশ ইরানও মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে, রত্নটা তাদের ঘরেই শোভা পাওয়াটা নৈতিক আর শোভন। তাই এ ইতস্তত দাবিমুখর দেশগুলোকে একহাত দেখিয়ে দিতে ভারত যদি দানের মন্ত্রে কোহিনূরের মালিক হয়ে ব্রিটিশদের সঙ্গে দহরম-মহরম সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়, তবে তা তাদের এক দুর্দান্ত চালই বলা চলে।

কিন্তু ইতিহাস সচেতনরা এই বালখিল্য বদান্যতায় ভ্রু কুঁচকাতেই পারেন। কেন, সেটাই ব্যাখ্যা করি। কোহিনূর কিন্তু বাকি প্রসিদ্ধ রত্নগুলোর মতো দেখতে-শুনতে ভালো বলেই সবার নজরকাড়া নয়। বরং রত্ন হিসেবে এর গুরুত্ব সামান্যই। কোহিনূর আসলে একটি কিংবদন্তি, এক অসম্ভব ইতিহাসের টুকরো। রক্তাক্ত আর অভিশপ্ত অধ্যায় জুড়ে আছে এর পরতে পরতে। পৃথিবীতে অন্য কোনো রত্ন নিয়ে এত বেশি কল্পকাহিনী রচিত হয়নি, এত ঠিকুজি হিসাব করা হয়নি, এমনকি এত কিংবদন্তিও তৈরি হয়নি। কেউ বিশ্বাস করে এটি ঈশ্বরের অশ্রু, যা পৃথিবীতে এসে পড়েছে। বেশ যথার্থ কল্পনাই বটে। আর মহামূল্য এই রত্নে যে-ই হাত দেবে, তার জীবনই নাকি দুঃখে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। হাজার বছরের ইতিহাসও তা-ই সাক্ষ্য দেয়। কোহিনূরের উৎস নিয়ে সবচেয়ে প্রচলিত ধারণা হলো, তেরো শতকে অন্ধ্রপ্রদেশের কল্লুর খনি থেকে উত্তোলিত হয়েছিল এটি। সে হিসেবে এর প্রথম মালিক ছিল দক্ষিণ ভারতের কাকাতিয়া সাম্রাজ্য। কিন্তু এটা আবার মানতে রাজি নয় কিংবদন্তিপ্রিয় অনেকেই। তাদের বক্তব্য, এ হিরের আঁতুড়ঘর যাচাইটা এত সহজ নয়।

স্মরণাতীতকাল থেকেই এ রত্ন ভারত উপমহাদেশে ছিল, মহাভারতের বীর কর্ণ আর অর্জুনের আয়ত্তে থাকা সামন্তিক মণিই আসলে কোহিনূর। সেটা মেনে নিলে খ্রিস্টের জন্মেরও তিন হাজার বছর আগে গিয়ে হিসাব করতে হয় এর বয়স। পুরাণপ্রিয় কেউ বলেন, হিরেটা প্রথমে পেয়েছিল এক রাখাল বালক। যার জোরে সে ভারতের এক রাজার প্রিয় পাত্র ও পোষ্যপুত্রের মর্যাদা পায়। সে রাখাল বালক পরে রাজা হয়; কিন্তু এ রত্নের অভিশাপে নিহত হয়। এ রত্নও বেদখল হয়ে এক হাত থেকে অন্য হাতে ঘুরতে থাকে। এই কিংবদন্তির সঙ্গে কিন্তু আশ্চর্য মিল আছে কোহিনূরের বর্ণাঢ্য মালিক নাদির শাহর জীবনের। নাদির শাহও রাখাল বালক ছিলেন এবং একসময় ইরানের সম্রাট হয়ে কোহিনূরেরও মালিক হন।

কিংবদন্তি যা-ই থাকুক, কোহিনূরের বিশ্বস্ত ইতিহাসে যে ব্যক্তি সব সময় ভাস্বর তিনি মোগল সম্রাট বাবর। কেননা বর্তমান নামকরণের আগে কোহিনূরের পরিচয় ছিল বাবরের হীরা নামে। এ এক আশ্চর্য ঐতিহাসিক ব্যাপার। কেননা বাবর কখনোই কোহিনূরের মালিক ছিলেন না, কখনো তাঁর পাগড়ি বা হাতের বাজুবন্ধনেও ব্যবহার করেননি। তিনি কেবল কোনো একদিন হিরেটা হয়তো স্পর্শ করেছিলেন মাত্র। কিন্তু তাঁর নামেই বহু বছর রত্নসন্ধানীরা মনে রাখে কোহিনূরকে। যখনই নতুন করে কেউ এর মালিক হয়েছে তখনই নিশ্চিত হতে চেয়েছে, এটা কি সেই হিরে, যা মহামতি বাবর উল্লেখ করে গেছেন? লিপিবদ্ধতা সে যুগের মানুষকেও কতটা প্রভাবিত করত, তারও এ এক প্রমাণ। কারণ সম্রাট বাবর তাঁর বাবুরনামায় প্রথম কোহিনূরের কথা উল্লেখ করেছিলেন।
অন্ধ্রপ্রদেশের কল্লুর খনিই কোহিনূরের উত্পত্তিস্থল ধরে নিলে মোগলদের আয়ত্তে এ হিরে আসে তারও প্রায় তিন শ-সাড়ে তিন শ বছর পর। চৌদ্দ শতকে আলাউদ্দিন খলজি যখন মালওয়া ও দাক্ষিণাত্য অভিযান করেন, সে সময় হিন্দু শাসক রায় মাহলাক দেও থেকে এ অতুলনীয় রত্ন মুক্তিপণ হিসেবে পান। তখনই তাঁরা জানতেন, এ হিরের মতো তুলনীয় দ্বিতীয় কোনো রত্ন ধরাধামে নেই। খলজি সেটি পরে টোমার রাজবংশকে দান করে যান কোনো এক সাহায্যের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ। তারপর সেটি এই বংশের সম্পদভাণ্ডারে রয়ে যায় বহুকাল। মোগলরা যখন পানিপথের যুদ্ধের পর আগ্রার দুর্গ ঘিরে ফেলে, তখন গোয়ালিয়রের মহারাজার স্ত্রী, সন্তানরা ও ভৃত্যরা পালাতে গিয়ে ধরা পড়েন। তাঁদের ভাগ্যে কী হবে সে সিদ্ধান্তের জন্য শাহজাদা হুমায়ুনের মত চাওয়া হয়। উদার শাহজাদা তেমন কোনো চিন্তাভাবনা না করেই তাঁদের মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দেন। বাবর তাঁর আত্মস্মৃতিতে পুত্রের এ ঘটনা নিয়ে লিখেছেন, বন্দীরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে তরুণ শাহজাদাকে অনেক রত্ন উপহার দিয়ে যায়। যার মধ্যে ছিল আলাউদ্দিন খলজির সেই বিখ্যাত হীরাও। এভাবে হীরাটা মোগল সাম্রাজ্যে প্রবেশ করলেও সেটি শিগগিরই চলে যায় পারসিয়ানদের হাতে। সম্রাট হুমায়ুন তাঁর চরম দুরবস্থার সময়ও কোহিনূর হাতছাড়া করেননি। কিন্তু পরে পারস্যের সম্রাট শাহ তাহমাস উপহার দেন হীরাটা—তাঁকে আশ্রয় দেওয়ায় কৃতজ্ঞতা হিসেবে। সম্রাট তাহমাস হীরাটা কোনো কারণে নিজের কাছে আর রাখেননি, আরেকজনকে দান করে দেন। তিনি সম্ভবত ভয় পাচ্ছিলেন, কোহিনূরের অভিশাপ তাঁর গায়েও লাগে কি না! এটা বেশ প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত ছিল যে এই রত্ন কোনো পুরুষ ভোগ করলে তাকে দুর্ভাগ্য বরণ করতে হবে। শুধু নারী ও ঈশ্বর এটা পরিধান করতে পারবেন। কথিত আছে, এ কথা লেখা এক শিলালিপিও পাওয়া গিয়েছিল। কাকতালীয় হলেও, কোহিনূরের অধিকাংশ মালিকই অপঘাতে বা যুদ্ধে, নয়তো আত্মীয়স্বজনের ষড়যন্ত্রে মারা গেছেন। সম্রাট হুমায়ুন সিঁড়ি থেকে নামতে গিয়ে পা পিছলে মাথায় আঘাত পেয়ে মারা গিয়েছিলেন, সম্রাট শাহজাহান পুত্রের নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়েছেন, নাদির শাহ মারা যান নিজের কাছের মানুষের হাতে। এই অভিশাপের কথা এতটাই প্রচলিত যে কোহিনূর নিয়ে যত ইতিহাস বই আছে, সেগুলোতেও এর উল্লেখ আছে। ফরাসি পর্যটক ট্যাভারনিয়ের, যাঁর সৌভাগ্য হয়েছিল ভারতের সব বিখ্যাত হীরা দর্শনের, তিনিও তাঁর বিখ্যাত সিক্স ভয়েজেস বইতে এ কথা বলে গেছেন। এমনকি ব্রিটিশরাও এই কুসংস্কারে বিশ্বাসী। আজ পর্যন্ত কোনো ব্রিটিশ রাজপরিবারের কোনো পুরুষ সদস্য এই রত্ন ছুঁয়েও দেখেনি।

সম্রাট হুমায়ুন থেকে কোহিনূর হাতছাড়া হওয়ার পর সেটি আবার মোগলদের কাছে আসতে বেশ কয়েকবার হাতবদল হয়। শাহ তাহমাস আহমেদ নগরের রাজা বুরহান নিজাম শাহকে কোহিনূর উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই উপহার উপযুক্ত প্রাপকের হাতে পৌঁছেনি বলেই ইতিহাসবিদরা মনে করেন। ধারণা করা হয়, সেটির বাহক জামাল শাহ মাঝপথে বিজয়নগরে হিরেটা বিক্রি করে দেন। তারপর এই অতুলনীয় রত্নের ভাগ্যে কী ঘটেছিল, সেটি আবারও প্রহেলিকাময় অধ্যায় হিসেবে থেকে যায়। কোহিনূরকে এরপর আমরা আবিষ্কার করি ১৬৫৬ সালের ৭ জুলাই, জাঁকজমকপূর্ণ একটি দিনে, মোগলদের রাজধানী দিল্লিতে। ওই দিন দৃশ্যপটে আবির্ভূত হন ইতিহাসের বিখ্যাত রত্ন ব্যবসায়ী মীর জুমলা। অতি সাধারণ এক তেল ব্যবসায়ীর পুত্র জুমলা নানা চতুরতায় বিপুল রত্ন ও সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। সেদিন তিনি মোগল সম্রাট শাহজাহানের জন্য উপহার হিসেবে নিয়ে আসেন কোহিনূর। পরবর্তীকালে সম্রাট শাহজাহানের খুব পছন্দের বস্তুতে পরিণত হয় কোহিনূর। সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এটি মোগলদের কাছে ছিল। পারস্য সম্রাট নাদির শাহ মোগলদের থেকে কোহিনূর ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। ১৭৩৯ সালে নাদির শাহ দিল্লিতে মোগল সম্রাট মোহাম্মদ শাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন। এর কিছুদিন আগেই কর্ণালের যুদ্ধে মোগলরা নাদির শাহর বাহিনীর কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। তাই এ সাক্ষাৎ আসলে ছিল একজন জয়ী সম্রাটের পরাজিত শত্রুশিবিরে আনন্দ ভ্রমণের মতোই। দিল্লিতে তিনি বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে আসেন। নাদির শাহ ছিলেন অত্যন্ত চতুর ও ধূর্ত। তা না হলে অবশ্য তিনি সম্রাট হতে পারতেন না। কেননা তিনি কোনো রাজপরিবারের সদস্য ছিলেন না। অপর দিকে সে সময়কার মোগল সম্রাট মোহাম্মদ শাহ ছিলেন অযোগ্য ও লম্পট। কথিত আছে, হারেমের রমণীদের সান্নিধ্য বা হাতে পানপাত্র ছাড়া তাঁকে কখনো দেখা যেত না। নাদির শাহ তাঁকে বুদ্ধির প্যাঁচে ফেলে কোহিনূর নিজের জিম্মায় নিয়ে নেবেন—সেটাই স্বাভাবিক। নাদির শাহ জানতে পারেন, মোগল বাদশাহ তাঁর পাগড়িতে কোহিনূর লুকিয়ে রাখেন। তখন তিনি এক কৌশলের সাহায্য নেন। তিনি মোহাম্মদ শাহকে একটা প্রাচীন রীতির কথা মনে করিয়ে দেন—যেটা ছিল দুই বাদশাহ পরস্পর দেখা হলে বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে পাগড়ি বিনিময় করবেন। মোগল সম্রাটের বুঝতে বাকি ছিল না—এ প্রস্তাবে রাজি না হওয়ার অর্থ বন্ধুত্বের আহ্বান ফিরিয়ে দেওয়া। আর তখনকার পরিস্থিতিতে এটা করার সুযোগ তাঁর ছিল না। তাই তিনি পাগড়ি বিনিময় করতে বাধ্য হলেন। এভাবেই নাদির শাহ হীরাটির মালিক হয়ে যান। নিজ কক্ষে এসে এর দ্যুতিতে চমকে উঠে নাম দেন কোহিনূর বা আলোর পাহাড়।
কোহিনূর তার রক্তাক্ত ইতিহাস প্রলম্বিত করে এর পরে আরো কয়েকবার হাতবদল হয়। পারস্য থেকে সেটি চলে যায় আফগানিস্তানের শাসকদের কাছে। তার পরই শেষ ভারতীয় শিখ সম্রাট রণজিৎ সিং মালিক হন এর। কোহিনূরের অভিশপ্ত আঁচড় একমাত্র রণজিৎ সিংই এড়িয়ে যেতে পারেন। কোহিনূরের মালিকদের মধ্যে অন্যতম বর্ণাঢ্য জীবন ছিল তাঁর। তিনি কোহিনূরের সর্বোচ্চ ভোগকারী বা ব্যবহারকারীও ছিলেন। নিজ হাতে পরতেন। স্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধ হয়ে মারা যান। অসাধারণ সাফল্যে রাজ্য পরিচালনা করেন। ধারণা করা হয়, মৃত্যুর কয়েক দিন আগে তিনি কোহিনূর জগন্নাথ মন্দিরে দান করে যাওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু তাঁর সে ইচ্ছা পূরণ করা হয়নি।
রণজিৎ সিংয়ের মৃত্যুর পর সুশৃঙ্খল শিখ সাম্রাজ্যে ফাটল ধরে, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়ে। সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র ও গুপ্তহত্যা শুরু হয়। ইংরেজরা এটাকে সুযোগ হিসেবে নেয়। কেননা তখন পুরো উপমহাদেশে একমাত্র শিখদের পাঞ্জাবই ছিল ব্রিটিশদের আওতামুক্ত । শুরু হয় অ্যাংলো শিখ যুদ্ধ, যেখানে ইংরেজরা বিজয়ী হয়। ইংরেজরা পরবর্তী সময়ে রণজিৎ সিংয়ের এগারো বছরের পুত্র দালিপ সিংকে পুতুল সম্রাট হিসেবে সিংহাসনে বসায় এবং শেষ লাহোর চুক্তি সম্পন্ন করে। এই চুক্তির ধারা অনুযায়ী রাজ্যের সব সম্পত্তির মালিক হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি। সেখানে এটাও উল্লেখ করা হয়, মহারাজা রণজিৎ সিংয়ের কোহিনূরের মালিক হবেন ইংল্যান্ডের রানি। মূলত এ চুক্তির মাধ্যমেই কোহিনূর ১৮৪৯ সালে এক ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজে করে তার উত্পত্তিস্থল ভারতবর্ষ ত্যাগ করে। দেড় শ বছরের বেশি পেরিয়ে গেলেও এ ভূ-খণ্ডে আর ফিরে আসেনি। রানি ভিক্টোরিয়ার একটি অপূর্ব সুন্দর টিয়ারায় মূল রত্ন হিসেবে স্থান হয় কোহিনূরের। পরে ১৯১১ সালে রানি মেরির মুকুটে স্থাপিত হয় হিরেটা। স্বামী পঞ্চম জর্জের অভিষেক অনুষ্ঠানে তিনি এ মুকুট পরেন। শেষতক ১৯৩৭ সালে রানিমাতা এলিজাবেথের মুকুটে স্থান পায় বিখ্যাত এ হীরক খণ্ড। ২০০২ সালে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় তাঁর কফিনের ওপর রাখা ছিল মুকুটসহ এ বিখ্যাত রত্ন। বিশ্ববাসীর সামনে শেষবারের মতো টিভির পর্দায় সরাসরি সেদিনই প্রদর্শিত হয় কোহিনূর। বর্তমানে লন্ডন টাওয়ারের জুয়েল হাউসে রক্ষিত আছে রত্নটি। নতুন কোনো জোরালো দাবি না তোলা হলে এই সুরক্ষিত অবস্থান হয়তো পরিবর্তন হচ্ছে না শিগিগরই। পৃথিবীর ইতিহাসে কোহিনূর আসলেই একটি অবিশ্বাস্য রত্ন। কেননা ভারতীয় উপমহাদেশের এমন আর কোনো বস্তু নেই, যা নিয়ে আলোচনা করলে ঘুরে আসা হয় ভারতের সুপ্রাচীনকাল থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত পুরো ইতিহাস। এটি ছাড়া অন্য কোনো স্মারক নেই, যা দিয়ে হাজার বছরব্যাপী বিস্তৃত পারসিয়ান, তুর্কি, মোগল, আফগান ও পাঞ্জাবি সাম্রাজ্য এবং ব্রিটিশদেরও একসূত্রে গাঁথা যায় বিশ্বস্ত ঐতিহাসিক তথ্য দিয়েই। আর পুরাণ, লোককথা হিসাব করলে ঈশ্বর আর দেবতারাও এর সঙ্গে যুক্ত। না, এটা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হীরা নয়, এমনকি সবচেয়ে সুন্দরও না। কুলিনান কোহিনূরের চেয়ে অনেক বড়, ক্রেমলিনের ওরলভ ডায়মন্ড বা ল্যুভরের রিজেন্ট ডায়মন্ড কোহিনূরের চেয়েও অনেক সুন্দর। তার পরও পৃথিবীর কোনো রত্নই ঐতিহাসিক ও রোমান্টিক মূল্যে কোহিনূরের ধারে-কাছেও নেই।

(লেখক : কোহিনূর নিয়ে রচিত উপন্যাস ‘মিনিমালিস্ট’-এর রচয়িতা)

প্রথম প্রকাশ : দৈনিক কালের কণ্ঠ, ২৪ এপ্রিল ২০১৬

পয়জনিং ১ : হারপিক টাইপ টয়লেট ক্লিনার পয়জনিং হলে কি করবেন, আর কি কি করবেন না!

আমাদের দেশে কোন ডাক্তার হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে ডিউটি দিয়েছে আর ২০-৩০ টা হারপিক বা অন্যান্য টয়লেট ক্লিনার পয়জনিং পায়নি, সেটা হতে পারে না। সবার বাসায়ই এই ধরনের টয়লেট পরিস্কারক থাকে, আর পরিবারের অভিমানী কিশোর বা কিশোরীদের সেই বোতলের প্রতি মারাত্মক ঝোঁক থাকে। তারা নাক বুজে অভিমান তাড়াতে কয়েকঢোক গিলে ফেলে। তারপরই অবশ্য রণে ভঙ্গ দিতে হয়। কারন আমাকে এখন পর্যন্ত কেউ বলেনি, এর স্বাদ সুবিধাজনক। তাহলে জেনে নেই আপনার পরিবারের কেউ যদি এই জিনিস চেখে ফেলে তাহলে কি কি করবেন আর কি করবেন না। তারআগে কিভাবে বুঝবেন সে হারপিক টাইপ কিছু খেয়েছে-

যেভাবে বুঝবেন হারপিক পয়জনিং:

১. প্রথমত রোগীর অস্থির আচরণেই আপনি বুঝতে পারবেন কোন বিষ জাতীয় কিছু হয়তো খেয়েছে। রোগী বলবে তার গলা জ্বলে যাচ্ছে, বমি করতে পারে, অতিরিক্ত লালা ঝরতে পারে।
২. মুখ দিয়ে ঝাঝালো কটু গন্ধ আসবার কথা, হারপিকের গন্ধ পেলেই কনফার্ম হয়ে যাবেন
৩. রোগী অধিকাংশ সময় নিজেই বলবে কি খেয়েছে
৪. বুঝতে না পারলে বাথরুমে বা আশেপাশে দেখুন, খেলে নিশ্চয়ই কোন আলামত পাবেন, হয়তো বোতল উল্টে আছে বা মেঝেতে হারপিক পড়ে আছে।
কি করবেন:
১. শরীরের কোন স্থানে বিষ লাগলে সেটা যে বিষই হোক তা ধুয়ে ফেলতে হবে, পোষাকে লাগলে পোষাক পাল্টে দিতে হবে, চোখে লাগলে প্রচুর পানি দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে চোখ ধুয়ে ফেলতে হবে
২. যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যাবেন
৩. নি:শ্বাস নিচ্ছে কিনা লক্ষ রাখুন। মুখে ফেনা বা বমি জমা হলে সাথে সাথে পরিষ্কার করে দিন পরিষ্কার কাপড় ব্যবহার করে যাতে সেগুলোর কারনে শ্বাস প্রশ্বানে কোন সমস্যা না হয়। ৪. রোগী অজ্ঞান হয়ে গেলে বাম পাশে কাত করে শুইয়ে রাখবেন, তাতে পেট থেকে কিছু বের হয়ে ফুসফুসে যাবে না ।
৫. পানি যদি খেতে চায় অল্প করে খাওয়ান, তবে শুয়ে না, বসে খাবে, কারন শুয়ে খেলে পানি পেটে না গিয়ে ফুসফুসে চলে যেতে পারে, তখন আরো বড় সমস্যার উদ্ভব হবে। ( তবে পানি না খাওয়াই ভাল, এটা নিয়ে আসলে দ্বিমত আছে)
কি করবেন না:
১. কিছুই খাওয়ানোর চেষ্টা করবেন না। ( অতিরিক্ত তৃষ্ণার্ত হলে সামান্য পানি খাওয়াতে পারেন)
২. অনেকে বমি করার জন্য রোগীকে উৎসাহ দান করে, বমি হতে পারে এমন কিছু খাওয়ানোরও চেষ্টা করে, এটা করা যাবে না, রোগী আরও খারাপ হবে।
৩. হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তারকে পেট ওয়াশ দেন বলে বলে বারবার বিরক্ত করবেন না, এ ধরনের পয়জনিং এ পেট ওয়াশ করতে গেলে পেট ফুটো হয়ে যাওয়ার চান্স থাকে। অন্তত এই ব্যাপারটা মনে রাখুন।
৪. হাসপাতালে নিতে দেরি করবেন না, কারন আপনার মনে হতে পারে রোগী ভাল আছে, কিন্তু হয়তো খানিক পরেই শ্বাসনালী ফুলে গিয়ে নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

এর পরিণতি কি হতে পারে:
এসব টয়লেট ক্লিনার মূলত করোসিভ এজেন্ট। এটা যখন আমাদের দেহের সংস্পর্শে আসে তখন টিস্যু ড্যামেজ করে দেয়, ক্ষত তৈরি করে। হারপিক টাইপ ফ্লুইড মূলত খাদ্যনালী ও পাকস্থলীতে প্রথমে ক্ষত তৈরি করে, তারপর সেসব ক্ষত যখন সেরে উঠে তখন জায়গাগুলো সরু হয়ে যায়, তাই এই পয়জনিং এ মৃত্যু হবার চান্স কম হলেও আজীবন রোগীকে ভুগতে হতে পারে। আমার দেখা এক হারপিক পয়জনিং এর রোগী সেরে উঠার ২-৩ বছর পরও শক্ত খাবার খেতে পারতো না,তরল জাতীয় খাবার খেয়ে জীবন পার করছে। বেশি মাত্রায় গ্রহন করলে পাকস্থলী ফুটো হয়ে যাওয়ার চান্স থাকে, যেটা হলে ইমার্জেন্সি সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে।

তথ্যসূত্র: ১. ন্যাশনাল গাইডলাইন ফর পয়জনিং ২. ডেভিডসন'স প্রিন্সিপাল এন্ড প্র্যাকটিস অব মেডিসিন ২২ এডিশন