পণ্যের বিজ্ঞাপন থেকে যে কারণে মূল্যবোধ শিক্ষার আশা করা ভুল!

আমরা নানা পণ্যের বিজ্ঞাপন দেখে মাঝে-মধ্যেই হতাশ হই, অনেকে হা-হুতাশ করে বলে এই অ্যাড দেখে লোকে কি শিখবে, আজকেও একজনের দীর্ঘ স্ট্যাটাস পড়লাম যে কোন এক বিজ্ঞাপনে নারীদের গৃহস্থালি কাজের আবশ্যক হিসেবে দেখানোতে তার আঁতে লেগেছে, এটা নাকি আমাদের ভুল দিকে গাইড করতে পারে বা এতে নারীদের অসম্মান হতে পারে। কিন্তু অ্যাড থেকে কোন মূল্যবোধ আশা করাটা একদমই গোড়ার গলদ। বিজ্ঞাপন কখনই শিক্ষার উপকরণ না, বিজ্ঞাপন থেকে কখনোই কিছু শেখা যাবে সেটা আশা করা ঠিক না, যদি যায় সেটা বাড়তি পাওনা, কিন্তু না শেখা গেলে সেটা বিজ্ঞাপনের ব্যর্থতা না।
সেদিন একটা বইয়ে পড়ছিলাম শত শত বছর ধরে পণ্যের প্রসারের জন্য কিভাবে বিজ্ঞাপনে মিথ্যা তথ্য দেয়া হয়। পেপসোডেন্ট এর বিজ্ঞাপনকে বলা হয় বিজ্ঞাপণের একটি সোনালী উদাহরণ, আঠার শতকে আমিরিকানরা দাঁত মাজতো না ( সিরিয়াসলি, তারা এটার প্রয়োজনই অনুভব করতো না), সেসময় যদিও বেশ কয়েকটি টুথপেস্ট কোম্পানি ছিল কিন্তু কেউ তাদের পণ্যকে প্রচলিত করতে পারেনি। পেপসোডেন্ট তখন কিছু বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে দারুণ ভাবে সফল হয়, তাদের সফলতার একটা কারণ ছিল তাদের পেস্টে অ্যাসিডিক কিছু এলিমেন্ট ছিল যার কারনে দাঁত মাজার পর মুখ জ্বলতো এবং একটা কৃত্রিশ ফ্রেশ ভাব আসতো, অন্য টুথপেস্টগুলোর উপকারী উপাদান একই থাকা সত্ত্বেও তারা আমেরিকানদের দাঁত পর্যন্ত উঠতে পারে নাই। পেপসোডেন্ট তাদের এই অপ্রয়োজনীয় অম্লীয় উপাদানজাত ফ্রেশনেসকে কাজে লাগায়, যা একটা মিথ্যাচার। এমনকি আজকে দুনিয়ার তাবৎ টুথপেস্ট কোম্পানী এইসব উপাদান ব্যবহার করে মানুষকে কৃত্রিম এই ফ্রেশনেস দেয়ার জন্য। হরলিকস, কমপ্ল্যানের মত কোম্পানীগুলোর দেয়া প্রত্যেকটি তথ্যই মিথ্যা- সেটা অনেকেই জানে, শ্যাম্পু বা ডিটারজেন্টে যে ফেনা তৈরি হয় তা চুল বা কাপড় পরিষ্কারের জন্য একদমই প্রয়োজন নেই, ফোন কোম্পানীগুলো দেশপ্রেম জাতীয় যেসব অনুভূতি নিয়ে কাজ করে সেটা বিদেশী কোম্পানীর মূল অনুভূতি নয় সেটা কে না জানে, এসব নানা মিথ্যাচারই পন্য উৎপাদনকারীর টিকে থাকার হাতিয়ার- তাদের বেশি দোষ দিয়ে লাভ নাই।
বিজ্ঞাপন আসলে মানুষ যা চায় তাই প্রচার করে। আজকে ফেয়ার এন্ড লাভলি ফর্সা ত্বকের প্রচারণা চালাচ্ছে তারমানে এই না, তারা ফর্সা ত্বক ভাল সেটা নতুন করে বলছে, উপমহাদেশের মানুষ মনে করে ফর্সা চামড়া সুন্দর তাই সেটাই তারা ব্যবহার করছে। সাহিত্য সমাজের দর্পণ কিনা আমি শিওর না, কিন্তু বিজ্ঞাপন অবশ্যই সমাজের দর্পণ। নারীকে গৃহস্থালী কাজে বিজ্ঞাপন মোটেও উৎসাহ দিচ্ছে না, এদেশের অধিকাংশ নারী গৃহস্থালী কাজে নিয়োজিত সেটাকেই তারা ব্যবহার করছে।
এটা ঠিক পণ্যের বিজ্ঞাপন সবসময় মিথ্যাচার করে না, তবে প্রয়োজন হলেই করে- মূল কথা হল তারা তাদের টার্গেট কাস্টমারদের চাহিদা অনুযায়ী তথ্য সরবরাহ করে।
নৈতিকতা, লিঙ্গ বৈষম্য এসব নিয়ে সচেতনতা তৈরি করা মিডিয়ার দায়িত্ব সেটা ঠিক, নৈতিকতা টার্গেট করে সরকারি নানা প্রচারণা, নানা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এর জনসচেতনতা মূলক কাজ, ভাল পরিচালকের নাটক সিনেমা, ডকুমেন্টরি বা ডকুড্রামা, ভাল গল্প-উপন্যাস এ দায়িত্ব পালন করে-কারন এসব নির্মাতা গল্পকারদের নিজস্ব দর্শন থাকে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উদ্দেশ্য থাকে।
কিন্তু একটা পণ্যের বিজ্ঞাপনের কি উদ্দেশ্য থাকে, কি দর্শন থাকে- তার পণ্যের প্রচারণা-শুধুমাত্র এটিই। আমার একটি পন্যনির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান থাকলে আমি যখন বহু খরচ করে একটা বিজ্ঞাপন দেব সেখানে আমি নৈতিকতা প্রচারের বিলাসীতা করবো না, আমি চাইবো আমার টার্গেট কাস্টমারদের কিভাবে কনভিন্স করা যায়।
তবে হ্যা, আমি তখনই আমার আমার বিজ্ঞাপনে নৈতিকতা বা দেশপ্রেমের মত অনুভূতিকে প্রচার করবো যখন দেখবো আমার টার্গেট দর্শক-সমাজে নৈতিকতা, দেশপ্রেম খুব গুরুত্ব পাচ্ছে। তখন তাদের টানতে আমি সেসবের প্রচারণা চালাতে পারি।
উন্নত দেশে মিথ্যাচার করা বিজ্ঞাপনের সংখ্যা কমে যাচ্ছে তার একটা কারন হতে পারে, মানুষ সচেতন থাকায় মিথ্যা তথ্য পরিবেশন তার পণ্যের প্রসারের জন্য বরঞ্চ নেগেটিভ হয়ে যেতে পারে।

No comments:

Post a Comment