সিজারিয়ান সেকশন না নর্মাল ডেলিভারি : আপনি কিভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন, আপনার ডাক্তার কিভাবে সিদ্ধান্ত নেয় এবং স্বাস্থ্য গবেষকরা কি বলে?

সন্তান জন্মদান প্রক্রিয়া যে কারনেই হোক মানুষের ক্ষেত্রে এখনো একটা ঝুঁকিময় কাজ, সন্তান জন্মদিতে গিয়ে বহু মা এই আধুনিক যুগেও মারা যাচ্ছে। বাইবেলের একজায়গায় বলা আছে, ঈশ্বর আদি পাপের জন্য নারীদের অভিশাপ দিয়েছে তাদের সন্তান জন্মদান কষ্টকর হবে। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, অভিশাপটা লেগে গেছে (ঈশ্বরের অভিশাপ বলে কথা!)। মানুষের মত এত ঝামেলা অন্য কোন প্রাণীকে পোহাতে হয় না। আরেকটা ব্যাখ্যা হল (পাপিষ্ঠ নাস্তিকদের ব্যাখ্যা) মানুষের বিবর্তন ঠিক ভাবে হয় নাই। বার্থ ক্যানেলের তুলনায় গর্ভস্থ সন্তানের মাথার আকৃতি বড় এখনো। এতবড় মাথার সন্তানের জন্মদানে বৃহৎ হিপ দরকার, কিন্তু হাঁটাচলার জন্য সরু হিপ প্রয়োজন, এই অবসটেট্রিকাল ডাইলেমার ( obstetrical dilemma) কারনে প্রতি ১০০০ মানব প্রসূতি এর অন্তত একজনের বাচ্চার মাথা বার্থ ক্যানেল দিয়ে বের হওয়া সম্ভব না। এসব ক্ষেত্রে আধুনিক চিকিৎসা প্রচলিত হওয়ার আগে মা বা শিশু বা উভয়ই মৃত্যুবরণ করতো।
এসব কারনে অন্য যেকোন প্রাণীর তুলনায় মানুষের জন্মদান প্রক্রিয়া বহুগুণ পেইনফুল। দেখা যায়, প্রথম বার সন্তান জন্মদানকারী মায়ের গড়ে ৯ ঘন্টা লেবার পেইন সইতে হয়, মানুষের কাছাকাছি অন্যান্য এপদের জন্য এ সময়টা মাত্র ২ ঘন্টা।
এবার আসি সিজারিয়ান অপারেশন নিয়ে। এটা নি:সন্দেহে দারুণ একটা অপারেশন, গর্ভজনিত জটিলতার সর্বাধুনিক সমাধান। প্রথমে এটা প্রচলিত ছিল মূলত মায়ের জীবন রক্ষার্থে। তারপরও বেশ কম হত এটা, কারন কয়েকদশক আগেও ব্লাড ট্রান্সফিউশনের ভাল ব্যবস্থা ছিল না, অ্যানেস্থিশিয়া উন্নত ছিল না, ইনফেকশন প্রতিরোধের ব্যবস্থাও ভাল ছিল না। তাই সিজারিয়ান অপারেশনও বেশ রিস্কি ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে এটা একটা নিরাপদ অপারেশন হয়ে যায়, ইন্টার্নির সময় দেখেছি স্যার-ম্যাডামরা এটাকে পাত্তাই দেয় না, এমনকি অনেক ইন্টার্নও এ অপারেশন করার অনুমতি পায়। ভাল অ্যানেস্থিশিওলজিস্ট, ভাল ওটি, প্রয়োজনীয় রক্ত ও ঔষধ যোগাড় থাকলে গাইনী ও অবস্ এর ডাক্তারদের জন্য এটা আসলেই বেশ ছোট ও নিরাপদ অপারেশন।
তারপরও কথা থাকে, যতই নিরাপদ হোক প্রাকৃতিক উপায়ে নর্মাল ডেলিভারীর অপশন আমাদের অবশ্যই প্রথমে ভাবা উচিত, কারন একটা অপারেশন অপারেশনই। সেটাতে ইনফেকশনের ভয় থাকবেই, অ্যানেস্থেটিক হ্যাজার্ডের চান্স থাকবেই, নর্মাল ডেলিভারীতে মা যেখানে একদুইদিন পরই সুস্থ-স্বাভাবিক ভাবে হাঁটা-চলা করতে পারে, সেখানে সিজারিয়ান অপারেশন হওয়া মাকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য অন্তত দেড়মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলা হয়, ভারী কাজ করতে নিষেধ করা হয় তিনমাস পর্যন্ত।
তাই কিভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় নর্মাল না সিজারিয়ান সেটা জানা জরুরী সবার। এটা সম্পর্কে ধারণা না থাকায় ইদানিং দেখছি ডাক্তার এবং প্রসূতি এর পরিবারের সাথে মনোমালিন্য হয়, কেউ ভাবে প্রয়োজন ছাড়াই বোধহয় সিজারিয়ান করা হচ্ছে, আবার কোন প্রসূতির নর্মাল ডেলিভারী হওয়া সম্ভব বা উচিত সেও ভয় পেয়ে সিজারিয়ান করাতে চায়। আর ক্লিনিকগুলো তো ওৎ পেতে থাকে কখন অপারেশন করে পয়সা হাতানো যায়।
মোটা দাগে কখন সিজারিয়ান করাতে হবে তার লিস্ট:
১. প্রাইমিগ্রাভিডা ( প্রথম সন্তান হচ্ছে এমন মা) তে যদি বাচ্চা উল্টা থাকে বা ব্রিচ প্রেজেন্টশনে থাকে ( আল্ট্রাসনোগ্রাম এ বোঝা যায়) এবং তার সাথে যদি আর কোন সমস্যা থাকে।
২. বাচ্চার জন্মের ঠিক আগে আগে করা আল্ট্রাসনোতে যদি বাচ্চা ট্রান্সভার্স বা আড়াআড়ি অবস্থানে থাকে। ( ভার্টিকাল বা সোজা থাকার কথা)
৩. এর আগে জন্মদান সংক্রান্ত জটিলতা হয়ে থাকার হিস্ট্রি আছে।
৪. প্রসূতির যদি সেফালোপেলভিক ডিসপ্রপোরশন থাকে ( মানে গঠনগত বিষম অনুপাত)। এটা গাইনোকলজিস্ট যাচাই করে বুঝতে পারবে।
৫. প্লাসেন্টা প্রিভিয়া বা প্লাসেন্টা যদি সঠিক অবস্থানে না থাকে। ( আল্ট্রাসনোতে বোঝা যায়)
৬. এর আগে যদি ইউটেরাস রাপচার বা পারফোরেশন হওয়ার হিস্ট্রি থাকে।
৭. এর আগে দুইবারের অধিক সিজারিয়ান অপারেশন হয়ে থাকে যদি।
৮. দীর্ঘ সময়ের বন্ধ্যাত্ব থাকার পর প্রথম সন্তান জন্মের ক্ষেত্রে
৯. ডায়াবেটিস জনিত জটিলতা সহ ডায়াবেটিক প্রসূতি হলে
১০. এর আগে ভেসিকো ভ্যাজাইনাল ফিস্টুলার অপারেশন হয়ে থাকলে
১১. প্রসূতির সারভাইকাল ক্যান্সার ধরা পড়লে
১২. পেলভিক টিউমার থাকলে


এসব ক্ষেত্রে ডাক্তার আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখতে পারে সিজারিয়ান সেকশনের। কিন্তু এমনও হতে পারে, প্রসূতির কোন সমস্যা দেখা গেল না, তাই নরমাল ডেলিভারির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে, কিন্তু জন্মদানের সময় নতুন কোন জটিলতা দেখা দিল। তখনও ইমার্জেন্সি সিজারিয়ান সেকশন করা লাগে। এমন কিছু পরিস্থিতি হল-
১. বাচ্চার হার্টরেট অস্বাভাবিক হলে ( ডাক্তার স্টেথোস্কোপ দিয়ে বুঝতে পারবেন)
২. দীর্ঘ সময় ধরে ব্যথা ওঠা সত্ত্বেও ( ১৮ ঘন্টার বেশি) বাচ্চা না প্রসব হলে
৩. অবস্ট্রাকটেড লেবার ( ইউটেরাসের নর্মাল কন্ট্রাকশন থাকা সত্ত্বেও কোন মেকানিকাল অবস্ট্রাকশন যেমন সরু পেলভিস, বাচ্চার পজিশন সঠিক না থাকা বা অন্যকোন কারনে প্রসব অগ্রসর হচ্ছে না বোঝা গেলে)
৪. কর্ড প্রলাপস বা আম্বলিকাল কর্ড বাচ্চার আগেই বের হয়ে আসলে
৫. একলাম্পশিয়া ডেভেলপ করলে ( উচ্চ রক্তচাপ ও খিঁচুনি, কখনো এর সাথে প্রসূতি অজ্ঞান হয়ে যায়)
৬. ব্রো প্রেজেন্টেশন অর্থাৎ বাচ্চার মাথা সাধারণত জন্মের সময় বুকে লেগে থাকে, সেটা না হয়ে যদি ঘাড়ে লেগে থাকে ( মানুষ উপরের দিকে তাকালে যেমনটা হয়) তাহলে সিজারিয়ান সেকশন লাগতে পারে।
৭. অতিরিক্ত রক্তপাত
৮. অ্যামনিওটিক ফ্লুইড ( যে তরলে বাচ্চা ভেসে থাকে, পানি ভাঙলে যে তরলের উপস্থিতি বুঝতে পারেন প্রসূতি) এর তারতম্য ধরা পড়লে।


এবার কিছু প্রশ্নোত্তর।

প্রশ্ন: আমাদের দেশে সিজারিয়ান সেকশন এর পরিমান বেড়ে গেছে অনেক, এর কারন কি?

পুরো বিশ্বেই আসলে সিজারিয়ান সেকশন অনেক বেড়ে গেছে মূলত সার্জারির সফলতা বাড়ার কারনে। আমাদের দেশে কয়েকদশকে শতকরা বিশভাগ বেড়েছে এই অপারেশন। ইংল্যান্ডে প্রতি চারজন প্রসূতির একজনের সিজারিয়ান সেকশন হয় মানে প্রায় ২৫ ভাগ। (সূত্র: বিবিসি), আমেরিকায় সেটা প্রায় ৩৩ ভাগ (সূত্র ) । সাইপ্রাসে ৫০ ভাগ শিশু জন্ম নেয় সিজারিয়ানে! অবশ্য ইউরোপের অনেক দেশে এ হার বেশ কম। যেমন- নেদারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড ইত্যাদি কয়েকটি দেশে মাত্র ৬ থেকে ৭ ভাগ শিশু সিজারিয়ান অপারেশনে জন্ম নেয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষকরা বলেন একটা দেশে শিশু ও মায়ের মৃত্যু কমাতে অন্তত ১৫ ভাগ সিজারিয়ান সেকশন হওয়া উচিত, এর বেশি হলে সেটা মৃত্যু হার কমাতে কোন সহায়তা করে না। আমেরিকান গাইডলাইন মতে অন্তত ১৯ ভাগ সিজারিয়ান সেকশন হওয়া উচিত যেকোন জনপদে।
এর বেশি হলে সেটা মোটেও কোন উপকার বয়ে আনে না। বরঞ্চ উল্টো প্রসব পরবর্তী জটিলতা বাড়াতে পারে।
আমাদের দেশে মূলত যেসব কারনে এ অপারেশন বেড়ে যাচ্ছে তার উল্লেখযোগ্য কারন হল
- নরমাল ডেলিভারির ব্যাপারে ভীতি
- নরমাল ডেলিভারি অনিশ্চিত, কখন হবে ঠিক নাই। এ অনিশ্চয়তা অনেকে পছন্দ করে না বিশেষত কর্মজীবি নারীরা।
- জন্মের আগে বাচ্চার অবস্থা যাচাই করার সুবিধা বৃদ্ধি পাওয়া, এ ব্যাপারে মানুষের সতর্কতা বৃদ্ধি পাওয়া
- অপারেশন করতে সক্ষম হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া


প্রশ্ন: ডাক্তাররা কিভাবে সিদ্ধান্ত নেয়?
ডাক্তারদের উপর করা এক সমীক্ষায় ( ইউ এস এ তে) তারা কবুল করেছে- কোন ধরনের সমস্যা মনে হলে তারা সিজারিয়ান সেকশনে চলে যেতে চান কেননা এরপর কেউ অভিযোগ করলে তারা যেন বলতে পারেন, তিনি সর্ব্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। কারন নর্মাল ডেলিভারিতে কোন সমস্যা হলে ডাক্তার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারেন কেন তিনি সিজারের কথা ভাবেন নাই।
তাছাড়া অনেক রোগীই নিজ থেকেই আগ্রহ দেখান সিজারিয়ান সেকশনে, সেক্ষেত্রে তাদের নিবৃত্ত করা যেকোন ডাক্তারের জন্য রিস্কি হয়ে যায়।

প্রশ্ন: আপনি কিভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন?
প্রসূতির উপরের কোন রিস্ক আছে কিনা সেটা জানতে তাকে রেগুলার চেকআপ এবং একজন প্রসূতিবিদের পরামর্শে থাকতে হবে। প্রসূতিবিদের সাথে খোলামেলা আলোচনা করে নেয়া উচিত, কোন রিস্ক থাকলে সেটা কি ধরনের সেটা বোঝা উচিত। কোন ধরনের রিস্ক না থাকলে ( যেটা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, রিস্ক থাকার সম্ভাবনা মাত্র শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগ) আপনারা যে নর্মাল ডেলিভারি করাতে চান সেটা তাকে জানান।

প্রশ্ন: দেশের ক্লিনিকগুলো কিভাবে সিদ্ধান্ত নেয়?
এটার উত্তর খুবই সহজ। কিছু ব্যতিক্রম বাদে অধিকাংশ ক্লিনিক হচ্ছে টাকা কামানোর প্রতিষ্ঠান। সিজারিয়ান সেকশনে তাদের ভাল অর্জন হয়, তারা যথেষ্ট ভাল প্রসূতিকেও সিজারিয়ান সেকশন করানোর জন্য চেষ্টা করাতে পারে। প্রসব ব্যথা নিয়ে সরাসরি যারা যে সে ক্লিনিকে গিয়ে হাজির হয় তারা এর ভিকটিম হতে পারে।
উচিত হল, ভাল কোন প্রসূতিবিদ ডাক্তারের পরামর্শে থাকা, নিয়মিত চেক আপ করানো এবং তার পরামর্শ অনুযায়ী হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ভর্তি হওয়া।


তথ্যসূত্র: ক্লিনিক্যাল গাইড টু অবসটেট্রিকস এবং গাইনোকোলজি-প্রফেসর সাইয়েদা নূরজাহান ভুইঁয়া, বিবিসি, স্ট্যাট নিউজ,WHO ওয়েবসাইট

1 comment:

  1. Casino Review, Ratings & Bonus - Mapyro
    Casino has an 경산 출장샵 awesome 화성 출장마사지 selection of games 진주 출장마사지 for players who like gambling. We have you covered. Find out what makes 군포 출장마사지 this 충청남도 출장안마 site different from the rest of the casino

    ReplyDelete