ডাক্তারের হাতের লেখা নিয়া হাইকোর্ট দেখা
১.
এককালে আমাদের যাদের হাতের লেখা খারাপ তাদের বাপ-মারা এই ভেবে সান্ত্বনা পাইতো যে ছেলে অন্তত ডাক্তার হতে পারবে। আক্ষরিক অর্থেই আমার অনেক সহপাঠী, সহকর্মী হাতের লেখা খুবই বাজে-ওরা আমাকে বলেছে ওদের ওই দুর্বোধ্য হাতের লেখাই এ পর্যন্ত আসতে ওদের উৎসাহ দিয়েছে। মেডিকেলে রিটেন পরীক্ষার তেমন মূল্য নাই। কারন আমরা যদি কোন প্রশ্নের উত্তর না পারতাম- সেটা হায়ারোগ্লিফিক লিপিতে লিখে দিয়ে আসতাম, স্যাররা মার্ক দিতে বাধ্য- ছেলে ডাক্তার হবে, হাতের লেখা বোঝা যাবে না এটাই সত্য, কি লিখছে সেটা সত্য না। এ কারনেই মেডিকেলের বড় বড় পরীক্ষাগুলো হয় গোল্লাপূরণ করে। গোল্লাপূরণ কখনো দুর্বোধ্য ভাবে করা যায় না।
২.
ডাক্তারদের হাতের লেখা খারাপ এটা শুধু আমাদের দেশের জন্য সত্য না। দুনিয়ার সব দেশে তাদের লেখা নিয়ে এই কথা প্রচলিত। তবে হাইকোর্ট যখন রায় দিল হাতের লেখা বোধগম্য করতে হবে তখন কিছু প্রশ্ন সামনে আসে। হাতের লেখা বোধগম্য বলতে আসলে কি বোঝায়- আমি যে কারো হাতের লেখা নিয়েই বলতে পারি- এই লেখা বোধগম্য না। কারন লেখা খুব স্বতন্ত্র জিনিস, একজনের সাথে অন্য জনের হাতের লেখা খুব কম মেলে। তাই এই বোধগম্যতার স্টান্ডার্ড আসলে কিভাবে যাচাই করা হবে?
যেকোন দুর্বোধ্য হাতের লেখার ডাক্তার অন্তত একশ জন ঔষধ বিক্রেতার সাক্ষ্য নিতে পারবে এই মর্মে যে তারা তাঁর লেখা বুঝেছে। তাই এই অভিযোগ আসলে কিভাবে করা হবে আমার কাছে পরিস্কার না।
৩.
এই আইনটা সত্যিই যদি কার্যকর করা হয়- সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে কিন্তু ডাক্তাররাই। কি রকম- সরকারি হাসপাতালের আউটডোরের চর্ম ও যৌন বিভাগের সামনে একদিন চলে যান। দেখবেন লাইনে দাড়ায় আছে মিনিমাম দুইশো রোগী ( স্বাভাবিক, এদেশের মানুষের চুলকানি বেশি)।
এখন সেখানে বসা ডাক্তার সাহেব স্বভাবতই ত্রিশ চল্লিশ সেকেন্ডে রোগ নির্ণয় করে প্রেসক্রিপশন লেখে। তার হাতের লেখা জয়নুল আবেদীনের মত হলেও এক সপ্তাহের ভেতরে সেগুলো বিগড়ে যাবে- হয়ে উঠবে পালি বা হিব্রু ফন্ট- বুঝতে পারবে কেবল ঔষধের দোকানদার। এখন এই ডিউটি ডাক্তার যদি আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সুন্দর হরফে লিখতে যায়- সবদিক থেকেই তার লাভ। বিশ পঁচিশটা রোগী দেখলেই হবে- মাথা থাকবে পরিস্কার- রাতে ঘুমও ভাল হবে।
৪.
অল্প স্বল্প অভিযোগে আমরা সরব থাকি, অধিক অভিযোগে নির্বাক।
কথাটার উপযুক্ত প্রয়োগ টের পেয়েছি যখন ইন্টার্নি কর্তাম তখন দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়া কত কিছু লিখতাম, এখন উপজেলা পর্যায়ে ডিউটি করে আমি পাথর হয়ে গেছি। মনে হয় ধুর বা... , কি হবে এইসব দশজনকে বলে।
আমাদের হাইকোর্ট 'সুন্দর হস্তলিপি' নিয়া চিন্তিত, কিন্তু পৃথিবীর আর কোন দেশে যে কেউ চাইলেই যে কোন ঔষধ ফার্মেসী থেকে কিনতে পারে কিনা সেটা আমার জানা নাই- ভীষণ সব দুর্নীতিগ্রস্থ দেশেও এটা স্বপ্নাতীত ব্যাপার, আর আমাদের শুধু গ্রামে গঞ্জে না, রাজধানী শহরও যেন সোনার খনি- চাইলেই যেকোন ঔষধ কেনা যায়। উন্নত দেশের অনেকে নিশ্চয়ই এটা জানলে আমাদের হিংসা করতো। হাইকোর্ট বা কেউই এই ঔষধের মহোৎসব নিয়া ভাবিত না।
৫.
আর ভাবছেন প্রেসক্রিপশন ছাড়া ঔষধ কেনা বন্ধ করবেন? এই প্রেসক্রিপশন যোগাড় করাও কোন ব্যাপার না। এদেশে বৈধ ভাবেই যে কেউ নামের আগে ডাক্তার লাগাতে পারে, রিপিট করছি বৈধ ভাবে। হাসপাতালে ডাক্তারদের সহকারী হিসেবে যাদের কাজ করার কথা, হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্ট বা স্যাকমো যারা- তারা কিন্তু একটা মামলা দিয়ে রাখছে তারা কেন নামের আগে ডাক্তার লাগাতে পারবে না- সেটার কিন্তু রায় হয় নাই। হাইকোর্ট এখানে নিরব। আর নীরবতা সম্মতি- আইনতই। তাই তারা নিজেদের নামের আগে ডাক্তার লিখছে- এইটা পুরোপুরি বৈধ। তারা যেকোন ঔষধ প্রেসক্রাইব করতে পারবে- আমি আপনি টু শব্দটি করতে পারবো না। গ্রামে গঞ্জে তারাই রোজ হাজার হাজার প্রেসক্রিপশন লিখছে, মজার ব্যাপার হচ্ছে আমি যেখানে আছি সেখানে তাদের অনেকের ভিজিট বিসিএস ক্যাডার হয়ে আসা ডাক্তারদের চেয়ে বেশি বা সমান!!
অথচ দুনিয়ার সব দেশেই প্রেসক্রিপশন লেখার জন্য লাইসেন্স লাগে, উন্নত দেশে ডাক্তারি পড়া শেষ করেও সেই লাইসেন্সের জন্য আলাদা পরীক্ষা দেয়া লাগে। আমি আমার দেশের যত বড় ডিগ্রী নিয়াই ইয়োরোপ আম্রিকায় যাই না কেন- ওদের দেশের নিজস্ব পরীক্ষা দিয়ে তারপর প্রেসক্রিপশন লেখার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। আর আমাদের দেশ ওপেন ফিল্ড, ভারত থেকে যদু-মধু ডাক্তাররা এসে অ্যাপোলোর চেম্বারে বসে রোগী দেখে যায়- কেউ টেরই পায় না।
৬.
এদেশ আসলে স্বর্গরাজ্য, হলিউডি মুভি টিভি সিরিয়ালে দেখি- ডাক্তার হয়েও কোন কোন ঔষধের জন্য ওরা কেমন কান্নাকাটি করে- সহকর্মীর হাতে পায়ে ধরে কয়- আমারে ওই ঔষধটা লেইখা দেও না, আমি ব্যথা সহ্য করতে পারতেছি না। সহকর্মী ডাক্তার কয়, তুমি আমার লাইসেন্স বাতিলের ধান্দা করতেছো। আর আপনি আমি দেখেন কি সুখে আছি- দুনিয়ার যেকোন অ্যান্টিবায়োটিক, যেকোন ব্যাথার ঔষধ, ঘুমের ঔষধ আমরা চাইলেই কিনে খাইতে পারি, পাড়া প্রতিবেশী ও আত্মীয় স্বজনকে খাওয়াতে পারি। এই একান্ত সুখে আমাদের মাঝে হাইকোর্ট কখনো বাঁধা হয়ে দাড়ায় নাই।
তাই বিভেদ ভুলে হাইকোর্টের পাশে থাকুন। সুখে থাকুন।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
ভালো
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDeleteভালো লিখেছেন
ReplyDelete