শাহাদুজ্জামানের ছোট গল্প পাঠ- বিহ্বল গল্পেরা!


শাহাদুজ্জামানের সাথে আমার পরিচয় অনিয়মিত কলাম এবং উপন্যাস ক্রাচের কর্ণেল দিয়ে। উপন্যাসটিতে তিনি আমাদের ইতিহাস আর কর্ণেল তাহেরকে নিরন্তর মমতায় মেলে দিয়েছিলেন সবার কাছে- তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবার জন্য ওই একটি সাহিত্যকর্মই যথেষ্ট ছিল, কিংবা বিসর্গতে দু:খ নামে অন্য উপন্যাসটি, যার লেখার ধরণটিই ঘোরলাগা অথবা তিনি যখন আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন শহীদুল জহিরের সাথে, যার প্ররোচনায় এবং সমর্থনে আমরা প্রথাগত পাঠকরা পুরনো ঢাকার ভূতের গলি বা ডলু নদীর পাড়ের গল্প পড়তে আগ্রহী হই সেজন্যও কিংবা ব্যক্তি আখতারুজ্জামানকে যতটুকুর চেয়ে বেশি ছোঁয়া যায় না তারও বেশিটুকু নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হন সে কারণটির জন্যও তিনি আমাদের হৃদয় উজার করা ধন্যবাদের দাবিদার। কিন্তু তার ছোটগল্প পড়তে গিয়ে আমরা দেখি কী অনন্য, কী অসাধারণ মৌতাতে বিভোড় করার ক্ষমতা নিয়ে তিনি আমাদের বলে গেছেন এক একটি গল্প। সৈয়দ শামসুল হক তাকে নিয়ে লিখেছিলেন, মুমূর্ষু বাংলা ছোটগল্পকে উদ্ধার করবার কাজে নিয়োজিত শ্রান্তিহীন শ্রম এবং সচেতন দৃষ্টি কল্পনা নিয়ে অতি সামান্য যে দু’-তিনজন, তাদের সহযাত্রী তিনি। তাঁর ছোটগল্পগুলি কি সফল? সেটা বিদগ্ধ সমালোচকেরা বলতে পারবেন, কিন্তু ছোটগল্পের সফলতা হিসেবে কোন পাঠক যদি ধরে নেয় সুনিপুণ প্লট যেমনটা আছে রবীন্দ্রনাথে বা পরশুরামে,কিংবা বনফুলে কিংবা বহুআগের ত্রৈলোক্যনাথের ছোটগল্পে, তাহলে সেখানে পাঠক হোঁচট খাবে, তবে কোন কোন গল্পে তার পূর্ণাঙ্গ প্লট আছে, তবে সেসব গল্পের তুলনায় সামান্য একটি জীবনবোধ নিয়ে তার যে ভাবনা সেটি আশ্চর্য রকম সুখপাঠ্য মনে হয় আমার কাছে। আবার তার গল্প পড়বার আগে এটাও চিন্তা ছিল তিনি যাদের শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় হৃদয়ে স্থান দিয়েছেন, সেই শহীদুল জহির এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে, তাদের গল্প বা লেখনীকে তাঁর ব্যক্তিজীবনের পাশাপাশি তার লেখাকেও স্পর্শ করেছিল কি? কিংবা করলেও আমার মত অগভীর পাঠকের দৃষ্টিগোচর হবে কি? ‘কয়েকটি বিহ্বল গল্প’ – গল্পগ্রন্থের গল্পগুলো আজকে আবার উল্টে দেখি। কয়েকটি বিহ্বল গল্প শাহাদুজ্জামানে প্রথম প্রকাশিত ছোটগল্প সংকলন। সংকলনের নিজস্ব রীতিতে এখানকার অধিকাংশ গল্পই যেমন অসাধারণ,আবার কয়েকটা মোটামুটি মানের গল্পও আছে। তবে শাহাদুজ্জামান প্রথমেই বলে নেন, গল্পটা কাদের জন্য, এক গল্পের ভেতরেই- 'পৃথিবীকে যার একদিন মায়াবী পারের দেশ বলে মনে হত, নিজেকে মনে হত ঝিলের মধ্যে জলঘাস, যিনি সেই জলজ চোখে চারদিকে তাকিয়েছেন ভয়ে, আগ্রহে, অনুরাগে, এ গল্পটি তার জন্য।' 'শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যে অভিনব এক শিশু কোলে পুরাণকথার সেই একাকী বালিকা যেভাবে চরাচরে নৈ:সঙ্গ ব্যপ্ত করে গেয়ে ওঠে-নিদারুণ শ্যাম, তোমায় নিয়ে বনে আসিলাম। কোলের শিশুটি তার স্বামী, এই অভূতপূর্ব সত্য সেই বালিকা যেমন করে বয়ে বেড়ায় এক, দুই, তিন করে বারটি বছর, সেইমতো আশ্চর্য কঠিন কোন সত্য যিনি বহন করে বেড়ান নিরন্তর, এ গল্পটি তার জন্যও।' ছোটগল্প নিয়ে পাঠ অভিজ্ঞতা লেখার একটা বিপজ্জনক দিক আছে, যারা এখনো পড়েননি তাদের জন্য ব্যাপারটা স্পয়লার হয়ে যাওয়ার চান্স থাকে। কিন্তু এসব গল্পে বলবার মত তেমন কোন গল্পই নেই, যা আছে তা এক একটি ভাবনা বলাই বেশি যৌক্তিক, তাই আলোচনাতেও সেসব স্পয়লার হয়ে উঠে না। অগল্প নামক গল্পের কথাই ধরা যাক, সেখানে লেখক ভাবেন তিনি আঁকবেন এমন এক আশ্চর্য সংকটের চিত্র, যেখানে এক মুক্তিযোদ্ধা দল পাহাড়ের কানাগলিতে আটকে পড়ে, আর তাদের রক্ষা পাওয়ার একটিই উপায় থাকে, সেটা হল দলের সাথে থাকা একমাত্র গ্রেনেড দিয়ে কোন এক যোদ্ধার আত্মাহুতি। গল্পটা শেষ পর্যন্ত লেখকের গল্প লেখা নিয়েই থাকে, তিনি এই কল্পিত কিন্তু ভীষণ সত্যি পরিস্থিতির অনেকগুলো সীমানা টানেন-এবং সেসব নিয়ে টানা পোড়েনে ভোগেন। কিছু গল্পের চমক গল্পে নয়, নামে। ছোট গল্পের জন্য এ এক অপরিহার্য দক্ষতা, নামকরণকে সার্থক করতে যেন গল্পটা বলে যাওয়া। তেমন একটি গল্প ক্যালাইডোস্কোপ, শুধু গল্পটি পড়লে আমার কোন বোধ হত না, কিন্তু নামকরণের কারনে একটা প্রিয় গল্পে পরিণত হয়। মানুষের মানসিক পরিবর্তন অনেককিছুতেই ধরা পড়ে, চাল চলনে, কথা বার্তায়, এমনকি একেকজনের সাথে একেকরকম হয়ে পড়ে। সবাই যেন মাল্টিপল পার্সোনালিটিকে ভোগা রোগী। একই চরিত্রে অভিনয় করে শুধু মহামানবেরা বা পশুরা, বাকি আমরা আজীবন সহস্র চরিত্র আর রূপে বদলে যাই যাত্রাপালার কুশলীদের মত। ‘মিথ্যা তুমি দশ পিঁপড়া’ গল্পটিও এমন এক পাল্টে যাবার গল্প। একই সাথে নামকরণটাও এখানে অসাধারণ। কয়েকটা গল্পকে আমার মনে হয়েছে শাহাদুজ্জামানের এনজিও ভিত্তিক স্বাস্থ্য প্রকল্পের কাজের অভিজ্ঞতার নির্জাস থেকে লেখা, সেসব প্রকল্পে নিশ্চয়ই তিনি পেয়েছিলেন হারুণের মত কাউকে, রফিকুল ইসলামের মত কাউকে, যাদের কথা তিনি লিখেছেন ‘হারুণের মঙ্গল হোক’ বা ‌স্যুট টাই অথব নক্ষত্রের দোষ’ গল্পগুলিতে। আমাদের দেশে, মধ্যবিত্তরা নানা যাতনা সয়ে বেড়ায়, সর্ব্বোচ্চ পড়াশোনার ডিগ্রীটা নিয়েও ভাল কোন চাকরী জুটাতে পারে না, এমন কিছু যুবক শেষমেশ এনজিওতে চাকরী নেয়, স্বভাবতই তাদের স্বপ্নগুলো মাটিচাপা দিয়ে এসে তারা ছুটে বেড়ায় নানা প্রজেক্টের জন্য নানা প্রান্তিক কোণে। গল্পের হারুণকে যখন গ্রামের কোন বৃদ্ধ বলে, বাবা মেট্রিকটা ঠিকমতো পাশ করলে আমাদের মতো গরীবদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে চাকরী করা লাগতো না, তখন আমরা এইসব যুবকদের স্বপ্নগুলো একধরনের হৃদয়ে-ক্ষতে পরিণত হতে দেখি। কিংবা রফিকুল ইসলামের মত, যে কিনা কর্তার মন যোগাতে স্যুট টাই যোগাড়ের পরিকল্পনা করে, পড়তে পড়তে আমাদের পাঠকদের মাথা হেট হয়ে আসে। কিংবা ‘ক্ষত যত ক্ষতি তত’ গল্পে পোশাক শ্রমিক মমতাজের গল্প শুনি, যে কিনা আমাদের শহরে গুহার মত কোন কোণে থাকে, রোজ সকালে নুড়ি পাথরের মত গড়িয়ে পড়ে রাস্তায়, তারা আমাদের কাছে অদৃশ্য জনতা, তাদের নিয়ে করা এ গল্প খুব চমকপ্রদ কিছু না, গল্পের চেয়ে সংবাদপত্রেই এধরণের ঘটনা আমরা অহরহ দেখি। তারপরও তাদের নিয়ে লেখকের ভাবনা জরুরী, সে অবশ্যকর্তব্যের দায়েই শাহাদুজ্জামান তাদের আঁকেন। কতিপয় ভাবুক গল্পটি আমার একটি প্রিয় গল্প এ গল্পগ্রন্থের, শাহাদুজ্জামান যখন বলেন, ভাবলে মানুষকে সুন্দর দেখায়-তখন কথাটার অন্যরকম একটি সত্যে আমি মন্ত্রমুগ্ধ না হয়ে পারিনা। এ গল্পে অন্যদের ভাববার জন্য যখন গল্পকথক একটি গল্প ছোড়েন গল্পের ভেতরের কয়েকজন শ্রোতার উদ্দেশ্যে, তখন সে গল্পের চরিত্ররা গল্পটি বিশ্লেষণ করে। এ যেন মানুষের ভাবনা নিয়ে, বিচারবোধ নিয়ে এক খেলা। টুয়েলভ অ্যাঙ্গরি ম্যান মুভির মত তাদের বিশ্লেষণে আমাদের মনে হয় মানুষ যেকোন পক্ষেই থাকতে পারে নিজ নিজ যুক্তিতে নিজেকে কনভিন্স করে। সংকলনের যে দুটি গল্প আমার পছন্দ হয় নি, সেগুলো হল মৌলিক এবং কারা যেন বলছে। গল্পগুলি হয়তো ভালই, কিন্তু শাহাদুজ্জামানের প্রচলিত প্রজ্ঞা অনুপস্থিত মনে হয়েছে। শেষ করি সবচেয়ে ভাল লাগা গল্পটি দিয়ে, মারাত্মক নিরুপম আনন্দ আমার মতে এ গ্রন্থের শ্রেষ্ঠ গল্প। তাতে কনিষ্ঠ একজন আলাপচারিতা চালায় তার জ্যেষ্ঠ কারো সাথে, যে উপদেশপ্রবণ। এই কনিষ্ঠ ও জ্যেষ্ঠ মিলে কয়েকটি প্রাকৃতিক দৃশ্যের পর্যালোচনা করে, যাতে মিশে থাকে আশ্চর্য দর্শন। জ্যেষ্ঠ: তুমি কি তোমার যাত্রার গতিমুখ বিষয়ে সচেতন? কনিষ্ঠ: সচেতন জ্যেষ্ঠ: তোমার যাত্রা কোন অভিমুখে? কনিষ্ঠ: আমার যাত্রা উদরপূর্তি হইতে ক্ষুধায়। জ্যেষ্ঠ: অধিকন্তু? কনিষ্ঠ: আকণ্ঠ পান হইতে তৃষ্ণায়। জ্যেষ্ঠ: এবং? কনিষ্ঠ: প্রবল আনন্দ হইতে গভীর বেদনায়। জ্যেষ্ঠ: এই যাত্রায় উল্লেখ্য কী অর্জন হইতেছে? কনিষ্ঠ: আমার বন্ধন শিথিল হইতেছে। জ্যেষ্ঠ: কিসের বন্ধন? কনিষ্ঠ: যথা নৈতিকতার,যথা লজ্জার, যথা আশার... যদিও পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ গল্পগ্রন্থের গল্পগুলো আমার মতে শাহাদুজ্জামানের সেরা ছোটগল্প, তারপরও কয়েকটি বিহ্বল গল্প এক অসাধারণ পাঠ অভিজ্ঞতা।

No comments:

Post a Comment